বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

আপন দৃষ্টি

আমাদের অহঙ্কার বিচারপতি ইমান আলী

আব্দুল মালিক

  • সাংবাদিক ও কলাম লেখক
  • ৪:৫৪ অপরাহ্ণ, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১

বাংলাদেশের ইতিহাসের ১৯৭২ থেকে বিচারপতিরা আসছেন এবং দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যাচ্ছেন। সব বিচারপতিদের সম্পর্কে কমবেশি সবার একটু একটু অথবা বেশি জানা আছে। আজ আমি যাকে নিয়ে এই লেখাটি লিখছি, তিনি হচ্ছেন বিচারপতি ব্যারিস্টার মোহাম্মদ ইমান আলী। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের বিচারপতি।

তাঁকে আমি অনেক ছোট বেলা থেকে চিনি। তিনি সম্পর্কে আমার চাচা। মায়ের কাছ থেকে তাঁর অনেক প্রশংসাও শুনেছি। শুনেছি তাঁর সততার কথাও। নম্র ও ভদ্র স্বভাবের কথা। আজকের বিচারপতি ইমান আলী যখন ছোট ছিলেন, তখন আমাদের বাড়ির বাংলোয় এসে পড়তেন। আমার মা ইমান আলী চাচা ছোট বেলার কথা আমাকে বলতে। তাকে দেখিয়ে উদাহরণ দিতেন। বলতেন ইমান আলীর মতো এত নম্র ও ভদ্র স্বভাবের মানুষ হয় না।

ছোট বেলায় ইমান আলী চাচার বেশিরভাগ সময় আমাদের বাড়িতে কেটেছে। সেই সুবাদে আমাদের বাড়িরসহ পাড়ার সকলের সাথে তাঁর খুব নিবিড় সম্পর্ক। ইমান আলী চাচা ছাতক উপজেলার জাহিদপুর প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। মঈনপুর হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পরেই তিনি লন্ডনে চলে যান।

আমি ১৯৭০ সালে আমার বয়স যখন ৫ বছর, তখন মা বাবার সাথে আমি লন্ডনে আসি। মাত্র ৮ মাস লন্ডনে থাকার পর মায়ের সাথে আবার বাংলাদেশের চলে যাই। এরপর আমার বাবা আমার চাচাতো ভাই একজনকে আমাদের ফ্যামিলির সাথে যুক্ত করে লন্ডন নিয়ে আসার জন্য এপ্লাই করেন।

সেই সময় পরিবারের একজন সদস্য লন্ডনী হলে তিনি তার পরিবারের সাথে ভাতিজা ভাগনা তাদেরকেও ছেলে বলে লন্ডন নিয়ে আসতেন। আমার চাচাত ভাইকে নিয়ে আমরা ভিসা নেওয়ার জন্য যখন ব্রিটিশ হাইকমিশনে গেলাম তাখন ইমিগ্রেশন অফিসার আমার চাচাত ভাইকে আমার আপন ভাই বলে সন্দেহ করায় ভিসা হয় নাই এবং আমার আর লন্ডনে আসা হয় নাই।

তারপর বাবা আবার যখন আপিল করেন এরপরও আপিল খারিজ হয়ে যায়। তারপর ১৯৮৪ সালে আমি ও আমার সহপাঠি বশির চাচা অর্থাৎ ইমান আলী চাচার চাচাতো ছোট ভাই আমরা দুজন তখন একসাথে থাকতাম। একদিন উনার সিলেটের সুবিদ বাজারের বাসায় আমরা যাই চাচার সাথে আমাদের কেইছ নিয়ে কিছু আলাপ হয়। এরপর আরও একদিন তাঁর শেখঘাট অফিসে গিয়ে যাই তখন অফিস বন্ধ হওয়ার সময় তাই চাচা বললেন, চল আজ তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাব।

গাড়িতে উঠে চাচা সোজা উনার শ্বশুর বাড়ির বাসায় আমাকে নিয়ে গেলেন। তাাঁর শশুর আলহাজ্ব আফতাব উদ্দিন আহমেদ। তিনি সিলেটের একজন নামকরা বিশিষ্ট উকিল। বাসায় যাওয়ার পর চাচা আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমি তখন বেশ লজ্জাবোধ করছিলাম।

কারণ উকিল সাহেব আমাকে পেয়ে তিনি ছোট বেয়ই সম্বোদন করে বেশ মজার মজার গল্প শুরু করলেন। একটু পরেই চাচার শাশুড়ী আসলেন এবং বললেন, শুধু গল্প করলেই হবে না, এবার ছোট বেয়াইকে নিয়ে খেতে আসুন। খাবার টেবিলে বসেই আবার শুরু হল, উকিল মানুেষ রসিক আলাপ-আলোচনা। প্রথমে যদিও লজ্জাবোধ করছিলাম কিন্তু এখন তাঁর কথাগুলো আমার খুব ভাল লেগেছিল কারণ তিনি বেশ

মজার মজার কথা বলে আনন্দ ও ফুর্তি করতে লাগলেন। চাচার শাশুড়ি বার বার বলছেন আহা কি শুরু করলেন, বেওয়াইকে খেতে দেন। তারপরও উকিলের বাঁশি বাজতেই থাকে। ওই দিন ব্যারিস্টার ইমান আলী চাচা আমার আম্মাকে নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করার কথা বললেন। পরে আমি আমার আম্মার সাথে কথা বলি। আমার আম্মা ইমান আলী চাচার সাথে দেখা করেন। এর পরবর্তী বছরই আম্মা লন্ডনে চলে যান এবং লন্ডনে এসে বাবাকে বুঝিয়ে বলেন। বাবা রাজি হলে চাচার (ব্যারিস্টার ইমান আলী) সাথে আমার কেইছ নিয়ে কথা বলেন এবং তিনি আমার ফাইল ঢাকা হাইকমিশনার এ পাঠিয়ে দেন।

পরের বছর আমাকে ভিসা নেওয়ার জন্য ঢাকা থেকে কল করা হয়। এর পর আমি লন্ডনে চলে আসি। ১৯৯০ সালে আমি লন্ডনে আসার পর ২০০০ সালে আব্বা মারা যান। এর পর আমার আম্মা বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশে থাকতেন। আমি সব সময় আমার আম্মাকে নিয়ে বাংলাদেশ যাতায়াত করতাম এবং যত বারই ঢাকায় এসেছি, চাচা খবর রাখতেন এবং এয়ারপোর্টে চলে আসতেন আমার আম্মাকে এক নজর দেখার জন্য।

এয়ারপোর্টে এসে তিনি আমার আম্মাকে বলতেন ভাবি আপনার পানের বাটা দিন। যদিও উনি পান-সুপারি খান না। তবুও এই মুহূর্তে আমার আম্মার বাটার পান খেতেন এবং যতক্ষণ আমরা এয়ারপোর্টে থাকতাম উনি আমাদের সাথে বসে উনার ছোট বেলার গল্প করতেন। বিদায়ের সময় আম্মাকে বললেন, নেক্সট টাইম আসার সময় ঢাকায় আসলে আমাকে খবর দিও। যদি কখনো সময় হাতে থাকে আমি গাড়ি নিয়ে এসে আমার বাসায় আপনাকে নিয়ে যাব।

২০০৮/৯ সালে একদিন লন্ডনে আসার সময় আমরা সিলেট থেকে ঢাকা এসে বিমানের ব্যবস্থাপনায় এয়ারপোর্টের কাছে একটি হোটেলে উঠি এবং চাচাকে ফোন করার সাথে সাথেই তিনি চলে আসেন। এয়ারপোর্ট যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আমাদের সাথে ছিলেন এবং সেদিন আমার আম্মা চাচার সামনে আমাকে বললেন, দেখ তোমার চাচা সারাটা জীবন সৎ পথে ছিলেন এবং আছেন, তাই মহান আল্লাহ তাঁকে আজ এই সম্মানের আসনে নিয়ে এসেছেন।

তোমার চাচার মত যদি সৎ পথে চল শুধু সম্মানই বাড়বে না তাাঁর মত তোমাকেও সবাই সম্মান করবে। চাচা সাথে সাথে আমার আম্মাকে বলছেন, “ভাবি আমার দাদা, দাদীম মা ও বাবা এবং আপনাদের দোয়ায় আজ আমি এখানে এসেছি, আপনি যদি আমার জন্য আর দোয়া করেন, আল্লাহ আমাকে আর উপরে নিয়ে যাবেন।

আজ আমিও গর্ব করে বলতে পারি ব্যারিস্টার ইমান আলী শুধু আমাদের অহংকার নয়, সারা বাংলাদেশের অহঙ্কার। বাংলাদেশের বিচাপতিদের ইতিহাসে এমন ব্যক্তি আর কেউ ছিলেন কি না আমি জানি না, তবে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি বাংলাদেশের এই পবিত্র বিচারালয় ব্যারিস্টার ইমান আলীর মতো মানুষের পদচারনায় আর মুখরিত হোক। প্রতি বছর যখন দেশে যাই ঢাকায় চাচাকে দেখে আসি।

গত ২০১৪ সালে আমার লেখা (বাংলাদেশের বাহিরে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার) বইটির একটি কপি দেওয়ার জন্য চাচার বাসায় গেলাম, আমার সাথে ছিলেন সুনামগঞ্জের বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহজাহান চৌধুরী, সুনামগঞ্জের আরেক বিশিষ্ট লেখক কবি সাহিত্যিক আলী সিদ্দিক এবং আমার এক ধুলাভাই সুলেমান মিয়া।

সেদিন চাচাও আমাকে উনার দুটি বই উপহার দিলেন বাংলাদের শিশুদের জন্য ন্যায় বিচার। চাচার সাথে আমার অসংখ্য ছবি আছে তারপরও আমার সাথী দুজনকে নিয়ে ছবি তুলতে পারমিশন চাইলে চাচা অনুমতি দিলেন না এবং তার কারণও ব্যাখ্যা করলেন। সুতারাং তিনি তাঁর অবস্থানকে সুন্দর ও পবিত্র রাখার ব্যাপারে খুবই সতর্ক।

আলাপ আলোচনার একপর্যায়ে আমাকে বললেন, আমাদের গ্রামের মানুষের সুবিধার্থে নদীতে একটি ব্রিজ নির্মাণ করতে চাইছি। কিন্তু গ্রামের কিছু অসাধু লোক এ নিয়ে এমপি সাহেব এবং বিচারপতির মধ্যে তালগুল পাকানোর চেষ্টা করে। এসময় বিষয়টি আমি (মুহিবুর রহমান এমপি) মানিক ভাইকে ঘটনা খুলে বলি। এমপি বললেন তিনি আরেকটি ব্রিজ বাজার সংলগ্ন কওে দেবেন। আলোচনা শেষে বললাম এলাকার বেশ কিছু লোক আপনার এবং বিচারপতির মধ্যে সব সময় দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখতে চায়।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এবার দেশে যাওয়ার পর চাচা বললেন সিলেট আসছেন আমিও সুনামগঞ্জের আমার এক দোলাভাই সুলেমান মিয়াকে নিয়ে সিলেট রেস্টহাউসে দেখা করি। জিজ্ঞাসা করলাম চাচা অনেক দিন পর সিলেটে আপনার সাথে দেখা, সিলেট আসার কারন জানতে চাইলে চাচা একটু হেসে বললেন, তুমি সব সময় বাড়িতে আসলে ঢাকায় দেখা করো তাই ভাবলাম এবার তোমাকে নিয়ে বাড়িতে বেড়াতে যাব।

চল কাল বাড়িতে যাব নতুন ব্রিজের কাজ কিভাবে শুরু হচ্ছে দেখে আসব। পরদিন সকালে আমরা বাড়ীতে গেলাম এবং গ্রামের অনেক লোক এসে জড়িত হলেন। স্কুল ও ব্রিজ নিয়ে আলোচনা হল। এরপর গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রামের অনেক প্রবীণ ব্যক্তিদের তাাঁর চাচা চাচী খুঁজে খুঁজে দেখতে লাগলেন। অনেকে নেই কোথায় কার কবর জেনে নিয়ে জিয়ারত করলেন। আমি বেশ কিছু ছবিও তুললাম। একমাত্র আমি ছাড়া, ছবি তুলার পারমিশন কারো ছিল না।

গত ২৬ শে আগষ্ট ২০১৮ চাচা হলিডে নিয়ে লন্ডনে আমার ঘরে আসলে রাতে খাবার পর আমি বললাম চাচা আপনাকে নিয়ে আমি লিখতে চাই, এবং আপাতত যা জানি তাই লিখব পারমিশন পেয়াগেলাম। তাই আমার এই ছোট্র লেখা আগামীতে আর লিখব ইনশাআল্লাহ। বিচারপতি ইমান আলীকে নিয়ে লিখার কারণ তিনি শুধু বিচারপতি নয়, তাাঁর মধ্যে রয়েছে একটি পবিত্র, আদর্শবান, সুন্দর ও সু-সৃংখল জীবন। যাকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে গড়ে উঠবে দেশের আগামী নতুন প্রজন্ম। ব্যারিস্টার ইমান আলী জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলেন নাই, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন এবং কারো কাছ থেকে জীবনে কখনো কোনো সুবিধা নেন নাই।

এমন কি ইমিগ্রেশন এডভাইজের জন্য ফিস ও নেন নাই। কারণ তিনি ছিলেন ব্রিটিশের নিয়োগ প্রাপ্ত ইমিগ্রেশন এডভাইজার অফিসার। ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন অফিসার হিসাবে তখন যদি তিনি চাইতেন কোটি কোটি টাকা বানাতে পারতেন। সেই সময় তাঁর অবস্থান এমনও ছিল ব্যারিস্টার ইমান আলী ইমিগ্রেশন অফিসারকে কোন কেইস সম্পর্কে তিনি যা বলতেন তাই সত্য বলে মেনে নিতেন। কারণ তারা জানে ব্যারিস্টার ইমান আলী কখনও মিথ্যা কথা বলেন না। তখন তাঁর ব্যাপারে সিলেটে অনেক আলোচনা হতো।

বিশেষ করে মানুষ বলতো যদি ব্যারিস্টার ইমান আলী চাইতেন একটি মিথ্যা বলে দিলে অনেক পরিবার এবং অনেক লোক লন্ডন যেতে পারতো। তখন তিনি ইচ্ছে করলে টাকার বিনিময়ে অনেক পরিবারকে মিথ্যা কথা বলে লন্ডনে পাঠিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাঁর সততার উপর নিজের আদর্শকে সঠিক রেখে সারা জীবন চলে এসেছেন। মিথ্যা কথা আর টাকার লোভ লালসা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নাই। আজও তিনি তাঁর সততার ধারা অব্যাহত রেখে চলেছেন।

সম্প্রতি বিচারপতি ইমান আলী আফ্রিকা এশিয়ো মেডিয়েশন এসোসিয়েশন কর্তৃক ‘ইন্টারন্যাশনাল মেডিয়েশন এ্যাওয়ার্ড‘ অর্জন করেছেন। বৃহত্তর সিলেটের কৃতি সন্তান বিচারপতি ইমান আলী সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ভাতগাঁও ইউনিয়ন এর সুপরিচিত আনুজানী গ্রামের সূর্য সন্তান।


অন্যান্য খবর