ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব নিদের্শন বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাম হবিগঞ্জের বানিয়াচং। কিন্তু গ্রামটির এর নামকরণ সম্পর্কে বহু মতভেদ রয়েছে। তবে অনেকের মতে বানিয়াচং এর পুটিয়াবিল নামে একটি প্রকান্ড বিল ছিল।
এই বিলে নানা জাতীয় পাখি বসবাস করত। বানিয়া নামে এক শিকারী এই বিলে একটি চাঙ নির্মাণ করে পাখি শিকার করত। কালক্রমে এই বিলটি প্রাকৃতিক কারণে ভরাট হয়ে গেলে বহু উচ্চ বৃক্ষলতাদিপূর্ণ ভূমিতে পরিবর্তিত হয়। এ ‘বানিয়া’ ও ‘চাঙ’ শব্দ থেকে বানিয়াচং নামের উৎপত্তি বলে বেশীরভাগ মানুষের ধারণা।
গ্রামটি জন্ম নিয়েছেন কয়েকজন দেশবরণ্য মহান ব্যক্তি। তাদের মধ্যে কেউ আবার বিশ্বজয়ও করেছেন। সৃষ্টিকর্তা যেন নিজে অকৃপণ হস্তে সবকিছু দান করেছেন তারপরও গ্রামটিতে উন্নয়নের ছোঁয়া তেমনভাবে লাগেনি। ৩২ দশমিক ৪৩ বর্গমাইল আয়তনের গ্রামটিতে প্রায় ১ লক্ষ ৩৫ হাজার লোক বসবাস করে। এর বেশীর ভাগ লোক কৃষি কাজের সাথে জড়িত।
ঐতিহাসিক কমলারানীর সাগরদীঘি, লক্ষীবাউরের জলাবন, রাজ বাড়ী, বাইসাইকেলে প্রথম বিশ্ব ভ্রমনকারী ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ী, মোঘল আমলের প্রাচীন মসজিদসহ রয়েছে অনেক পুরাকীর্তি যা দিয়ে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব।
১৯৯৭ সালের ১৯ অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় এলআর হাইস্কুল মাঠের জনসভায় সাগরদীঘিকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র করার ঘোষণা দেন। দিনাজপুরের রামসাগরের আদলে সাগরদীঘির পাড়েও পর্যটন পার্ক গড়ে তোলা হবে তিনি বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রায় ২১ বছর পেরিয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে আলোর মুখ দেখেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়ে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে পাল্টে যেত গ্রামটির অর্থনৈতিক চিত্র। সরকারেরও রাজস্ব আয় হত কোটি টাকা।
বাইসাইকেলে প্রথম বিশ্ব ভ্রমনকারী ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ, স্বগীয় হেমসেন, সুশীল সেন, মওলানা আব্দুল হামিদ ভাসানির সহযোদ্ধা মরহুম মৌলভী আব্দুল¬াহর মত দেশবরণ্য ও বিশ্বজয়ী ব্যক্তিরা এই গ্রামে জন্ম নিলেও গ্রামটিতে শিক্ষার ছোঁয়া তেমনভাবে লাগেনি। শিক্ষার হার মাত্র শতকরা ৫৮ ভাগ।
পঞ্চাশ খ্রিস্টাব্দে বানিয়াচং গ্রামের গোড়াপত্তন হয় বলে ধারণা। সাধারণত কয়েকটি পাড়া বা মহল¬া নিয়ে গঠিত হয় গ্রাম। কিন্তু এই সংজ্ঞাকে অচল করে দিয়ে ১শত ২৮টি পাড়া নিয়ে গঠিত এই বৃহত্তম গ্রামটি। যার আয়তন ৩২ দশমিক ৪৩ বর্গমাইল।
৪টি ইউনিয়ন পরিষদে বিভক্ত করা গ্রামটির জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৩৫ হাজার। গ্রামে হিন্দু ও মুসলমান স¤প্রদায়ের বসবাস। অনাধিকাল ধরে এই দু’স¤প্রদায়ের মাঝে চলে এসেছে সামাজিক স¤প্রীতি। ৮০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি প্রবাসীদের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণে। বিদেশী রেমিটেন্স আর্থসামাজিক উন্নয়নে অন্যতম অবদান রাখছে।
জানা গেছে, এক সময় পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো। তখন বানিয়াচং ছিল এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম গ্রাম। শিকাগো নগরে রূপ নেয়ায় আয়তন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে বানিয়াচং।
২০০৪ সালের ৭জুন বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী বানিয়াচং উপজেলা সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করেন বানিয়াচং পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম। এছাড়াও ড. শেখ ফজলে এলাহী বাচ্চুর “বানিয়াচং এর ইতিবৃত্ত” বইটিতে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং বলে উল্লেখ করেন। সুলতানী আমলে করদ রাজ্য ও মোঘল আমলে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে স্থানান্তরিত লাউর রাজ্যের রাজধানী ছিল বানিয়াচং।
দ্বাদশ শতাব্দীতে গ্রামটিতে কমলারাণীর দীঘি খনন করেন রাজা পদ্মনাভ। ৬৬.৯২ একর আয়তনের কমলারাণীর দীঘি বাংলাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম দীঘি হিসেবে স্বীকৃত। সাগরের মত বিশাল হওয়ায় অনেকে সাগরদীঘিও বলে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পল¬ী কবি জসীম উদ্দীন বানিয়াচং পরিদর্শনে এলে সাগর দীঘির প্রাকৃতিক পরিবেশও সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হন এবং এর পাড়ে বসে ‘ও রানী কমলাবতীর দীঘি’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন।
এছাড়া গ্রামটিতে মজলিশ খাঁর দীঘি, ঠাকুররাণীর দীঘি, দেওয়ান দীঘি ও জামাল খা’র দীঘি নামে চারটি রয়েছে। পুরানবাগ মসজিদ, বিবির দরগা, কালিকাপাড়া,দুই নম্বর (রাজবাড়ি) মসজিদ, রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, জয়কালি মন্দির, শ্যামবাউলের আখড়া প্রাচীন স্থাপত্যের নির্দেশন হিসেবে এখনো দন্ডায়নমান। তবে এসব প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষার কোন লক্ষণ নেই সরকারী বা বেসরকারীভাবে।
বৃহত্তম এই গ্রামটিতে যারা জন্ম নিয়ে দেশ ও বিশ্ববরণ্য হচ্ছেন, বাইসাইকেলে প্রথম বিশ্ব ভ্রমনকারী ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস, নাইট উপাধিতে ভূষিত ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ, মাস্টারদা সূর্যসেনের সহযোদ্ধা দুই সহোদর স্বগীয় হেমসেন, সুশীল সেন, মওলানা আব্দুল হামিদ ভাসানির সহযোদ্ধা মরহুম মৌলভী আব্দুল¬াহ, সাবেকমন্ত্রী ও সাংবাদিক সিরাজুল হোসেন খাঁন, কন্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, এছাড়া এশিয়ান ডেভেলাপম্যান্ট ব্যাংকের এমডি রজত মোহন নাগ ।