একটু বলি। ১৯৭১ সাল দীর্ঘ নয়টি মাস। পাকবাহিনীর গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী নির্যাতন, ইসলামের লেবাস ধারীদের শান্তি কমিটি গঠন। তখন এদেশের মানুষের অবস্থা এমন ছিল। যখন মুক্তিবাহিনী সামনে আসে বলে জয় বাংলা জীবন সামলা। আবার যখন পাকহানাদার বাহিনীর সামনে পড়ে তখন বলতো পাকিস্তান জিন্দাবাদ। জীবন বাঁচানো আমাদের কাজ। পাকবাহিনীর হাত থেকে জীবন বাচাতেই বলতেন পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
মুক্তিযোদ্ধের নয় মাস পাকবাহিনী ও রাজাকার, আল বদর আর আল শামসরা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ভাঙ্গচুর, সম্পদ লুট করে গণিমতের মাল বলে ফতোয়াজারী করে। মৃত গরুর পা কেটে নিয়ে রাতের অন্ধকারে হিন্দুবাড়ির দরজার সামনে ঝুলিয়ে রাখা। যুবতী মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া।
পাকবাহিনীর ক্যাম্পে শত শত যুবতীদের রাতভর ধর্ষণ করে দিনের বেলা উলঙ্গ করে পুকুরের পানিতে নামিয়ে রাখা। ধর্ষিত হতে হতে অনাহারে রোগে শুকিয়ে আসা যুবতী জীবিত থাকার কোন অধিকার নেই। তাই গ্রেনেট দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে, অন্যান্য যুবতীদের দিয়ে ক্যাম্পের পাশে গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা করা হত। মুক্তিযোদ্ধার মা-বাবার সামনে মেয়েকে উলঙ্গ করে ইজ্জত লুন্ঠন করে হত্যা।
মুক্তিযোদ্ধার এক বছরের শিশুকে মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পায়ের নিচে রেখে কচি মুরগীর বাচ্চার মত ছিড়ে তার দেহটাকে দুভাগ করে বাড়ির উঠানের ফেলে রাখা। ঘরে ঢুকে খাটের উপর শুয়ে থাকা শিশুটির দুটি পা ধরে আছাড়ে আছড়ে মেরে ফেলা। শিশুটির মুখ থেকে একটি করুণ চিৎকার তার পর আর দ্বিতীয় চিৎকার মা শুনতে পায়নি। নিরব নিস্তব্ধ হয়ে শিশুর নিরাপরাধ দেহটি শান্ত হয়ে পড়ে। আর মাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাকবাহিনীর ক্যাম্পে। গ্রেনেট দিয়ে খুছিয়ে খুছিয়ে মৃত বাবার লাশটিকেও শকুনের মত ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে যায়।
ভয়ে পালিয়ে যাওয়া যুবক ঘরে ফিরে যখন শুনল তার পরিবারের এই কাহিনী, তখন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে সেও জীবন দেয়। এভাবে ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দু লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে যখন বিজয় আসে, আনন্দে ভূলে যাই আমরা সব নির্যাতন আর নিপিড়নের কাহিনী। আবার ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট। শুরু হল মুক্তিযুদ্ধা নিধন, রেডিও টেলিভিশন থেকে পুড়িয়ে ফেলা হয় হাজার হাজার মুক্তি যুদ্ধের ডকুমেন্টারীর ছবি ও ভিডিও ফুটেজ।
ফিরিয়ে আনা হয় কূখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমসহ সকল রাজাকারদের। নিষিদ্ধ জামাতের রাজনীতির অধিকার দিয়ে প্রচার করা হল একদলীয় শাসন ব্যবস্থার অবসান হয়েছে। শুধু তাই নয় বহু দলীয় গণতন্ত্রের নামে চালু হয় একনায়কতন্ত্র মানে স্বৈরতন্ত্র। ১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ডের বিচার চাইতে যাওয়া কিছু নাগরিকে চপেটাঘাত করে থানা থেকে বের করে দেওয়া হয়।
১৫ই আগষ্টের কালোরাতে যে নির্মম হত্যাকা- হল তার বিচার যাতে কোনদিন কেউ করতে না পারে তাই সাংবিধানিক আইন করে ইনডেমনিটি অধ্যাদশ জারি করা হয়। ১৫ই আগষ্টের খুনীদের সরকারী নিরাপত্তা দিয়ে রাজনীতি করার অধিকার দেয়া হয়। অনেক খুনীকে পুরস্কৃত করে বিদেশী দুতাবাসে চাকরি দেয়া হয়।
বিদেশে থাকায় বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যাদের করুণ কাহিনী এখানে তুলে বাদ দিলাম। অনেক জীবন ও রক্তের বিনিময়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে আওয়ামী লীগ। মৃত্যুকে সামনে দেখেও একমাত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর শক্তিকে বিশ্বাস করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর এক স্বৈরাচার থেকে আরেক স্বৈরাচারের জন্ম হয়।
একমাত্র গণতান্ত্রিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একাই দুই সৈরাচারের মোকাবিলা করতে করতে হাজার হাজার কর্মীর আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ের পাশাপাশি স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্ধাপরাধী জামাত-শিবিরের সাথে যুদ্ধ করে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। মানুষ আবার বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখে। ৯৬ থেকে ২০০০ সাল তারপর আবার সেই রক্তের বন্যা, হাজার হাজার নেতা কর্মীকে হত্যা, শুধু তাই নয়, ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর বংশ নির্বংশ করে, আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতাদের একে একে হত্যা করে যেভাবে নেতৃত্ব শুন্য করার অপচেষ্টা হয়েছিল ২১শে আগষ্ট গ্রেনেট হামলা করে।
আওয়ামী লীগকে চিরদিনের জন্য নেতৃত্ব শুন্য করার জন্য একের পর এক হত্যাকা- চলতে থাকে। কিন্তু না সফল হতে পারে নাই স্বাধীনতা বিরোধীরা। ২১শে আগষ্ট শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে যাওয়া ৭৫ এর মত দুর্বল না হয়ে আর দ্বিগুন শক্তিতে ঘুরে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। ১৫ই আগষ্ট যদি শেখ হাসিনার মৃত্যু হতো তাহলে ২১ নয়, কম হলেও ৫০ বছরের জন্য ক্ষমতা থেকে দূরে থাকতো আওয়ামী লীগ।
সব চেষ্টা যখন বিফলে তখন চলছে আর গভীর ষড়যন্ত্র, জীবন বাঁচানোর জন্য যুদ্ধাপরাধী জামাত শিবির করেছে ইতিহাস বিকৃতি। সাঈদীর লিখে যাওয়া বই (তালিমুল কোরআন-এর ১০৫ পৃষ্ঠায় সাঈদী যুদ্ধবন্দী নারীদের বিষয়ে অপব্যাখ্যা দিয়েছেন। যা পড়ছে তার নিজেদের দলীয় হেফাজতে গড়ে উঠা বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, আনাচে কানাচে শত শত মাদ্রাসায় জামাত-শিবিরের হাজার হাজার কর্মীরা।
তারা প্রচার করছে ইসলামের জন্য মরলে শহীদ হওয়া যায় আর বাঁচলে গাজী হবে। তাদের বিশ্বাসেই ৭১ সালে নারী নির্যাতন করেছিল এই ধর্মান্ধরা। এবার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে কি হবে? একটু ভেবে দেখতে হবে। আবার মাথা তোলে দাড়াবে ৭১-এর প্রেতাত্মারা।