অনেকটাই লাজুক স্বভাব তাঁর! নিজেকে আড়াল করে রাখাই যেনো তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। তার রূপ-সৌন্দর্য্য প্রকাশেও তীব্র অনাগ্রহ। সেই রূপ প্রকাশেও খুব একটা আকুলতা নেই তার! চিরায়ত নিয়মের সে যেনো পুরোটাই বিপরীত। চলেছে আপন মহিমায়; অভিমানী ভঙ্গিতে! রূপের কী অহঙ্কার, না-কি এই রূপই তার অলঙ্কারÑতা বুঝারও ÿমতা নেই। বোরখাপড়া মেয়েটির মতো রূপবতী ‘বুজিরবন’ এভাবে আর কতদিন নিজেকে লুকিয়ে রাখবে, ঢেকে রাখবে নিজ রূপ-লাবণ্য! সময়ের ব্যবধানে, প্রয়োজনে একদিন সে হয়তো ঠিকই ধরা দেবে প্রকৃতিপ্রেমিদের কাছে। ঠিক এক সময় ভ্রমণপিপাসুরা তাকে খুঁজে বের করে নিলো। বা¯Íবে ঘটেছেও তাই।
বলছি, বুজিরবনের কথা; সিলেটের নতুন পর্যটন স্পটের কথা। যার অবস্থান জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরের কাছেই। সিলেট শহর থেকে আরেক প্রকৃতিকন্যা জাফলং যাবার পথে একটু দুর্গম এলাকায় গেলে দেখা দেবে সেই রূপবতী বুজিরবন! হিজল-করচসহ নানা প্রজাতির গাছের সমারোহ আছে এখানে, যেনো সবুজে আচ্ছাদিত। অনেকটাই মিঠাপানির বন সেই ‘রাতারগুলের’ মতোই।
বুজিরবন! নিসর্গের মাঝে লুকিয়ে থাকা এক অপরূপ বনাঞ্চল। জলের সঙ্গে তার মিতালী। বর্ষার অথৈজলে সে যেনো নবরূপে জেগে ওঠে। আপন সৌন্দর্যের সবটুকু মেলে ধরে, উজার করে দেয়। এসময় খুলে পড়ে তার বোরখার ঘোমটাও। আগন্তুুক আর পথিকদের কাছ থেকে সে নিজেকে আড়াল করে রাখে ঠিকই, কিন্তু আপন ভূবনের বাসিন্দাদের কাছে সে খুবই আধুনিক-উদার। বনের বিচিত্র সব গাছ, জলচর-স্থলচর-উভচর প্রাণি আর মাছশিকারীদের নিয়ে তার একান্ত আপন ভূবন। বর্ষার ¯্রােতসীনি জল তার স্বজন, পরম আত্মার-আত্মীয়। যৌবনের এ ভরা মৌসুমে সে যেনো নীল আকাশের সঙ্গে বন্ধুত খুঁেজ পায়। যেনো মনে হয়, পুরো আকাশ নেমে এসেছে বনের সান্ধিন্ধ্যে।
বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে বুজিরবন একটি ‘সোয়াম্প বন’। সভ্যতার ছোঁয়া বহির্ভূত প্রাকৃতিক এ বনটি যেনো নিসর্গের এক অপরূপ উদ্যান। জলকে ঘিরেই বনটির ’ইকোসিস্টেম’ তথা পুরো অ¯িÍত্ব নির্ভরশীল। সিলেটের জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলার একেবারে প্রান্তসীমায় অনেকগুলো হাওরের মধ্যে এক নির্জন স্থানে তার বেড়ে ওঠা, অবস্থান। করিচ ও কাপনা নদী চলে গেছে এ নদীর বুক বেয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুড়াখাই নদীর একটি শাখা। তিন নদীর মিলনস্থলে প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো বনটি আবহমান থেকে এখনও টিকে আছে, পড়ে আছে প্রকৃতিপ্রেমিদের জন্য!
সিলেট-তামাবিল সড়ক ধরে হরিপুরের পরেই করিচ সেতু। সে সেতু থেকে পশ্চিমদিকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দুরত্বের মধ্যেই বুজিরবনের অবস্থান। কিন্তু এরকম এক ব্য¯Í স্থান থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী কিভাবে এটি যে পর্যটকদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেলোÑসে যেনো এক রহস্য। দুর্গমতার কারণে হয়তো এমনটি হয়েছে। বনের বুক চিরে চলে যাওয়া নদীপথে গেলে দেখা যায়, হিজল-করচ-জারুল-বরুন-শেওড়া-বুরি আর কদমের লম্বা লম্বা সারি। গাছগুলো একটি আরেকটিকে ঘিরে ধরেছে আপন ভেবে। শতবর্ষী একেকটি হিজল গাছ নিজের ডালপালা আর পাতা দিয়ে অনেক জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে। গোধূলির নিমুঝিমু আলো-আধাঁরিতে এক একটি হিজল গাছকে মনে হয় গভীর ধ্যানে মগ্ন একেকজন সন্ন্যাসী। বনের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, মুর্তা, বেত, হুগলা আর শনের ঘন বন। বড়গাছগুলোর নিচের এসব ঝোপঝাড় দেখলে মনে হতে পারে, ছোটবনগুলোকে যেন এরা মায়ের মতো আদরের চাদরে ঢেকে রেখেছে। বর্ষার বহমান পানিতে মাথা উচুঁ করে কেনো রকমে এগুলো জীবনের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধ করছে। বনের পশ্চিম-উত্তর দিকে রয়েছে ইকড়ের বিশাল হাওর। দিগন্তের ওপারের খাসিয়া-জৈন্তায়া পাহাড় তৈরি গভীর দৌত্যনা।
বুজিরবন জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি বন। বিচিত্র প্রজাতির উদ্ভিদ, জলচর ও স্থলচর প্রাণির এক সমৃদ্ধ আবাসস্থল এ বন। বনের মধ্যে দেখা মেলে উদবিড়াল, গেছো ইদুর, কাঠবিড়ালী, খেকশিয়ালসহ নানা প্রজাতির প্রাণি। অনেক মেছোমাঘও বনের মধ্যে বসবাস করে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জেলেরা। চিল, ঈগল, ডাহুক, কানাবক, বালিহাস আর নানা প্রজাতির পাখি দাপিয়ে বেড়ায় বনের মধ্যে। বিশেষ করে, শীতকালে পরিযায়ী পাখীর কলকাকলীতে মুখরিত থাকে এ বন। দেশিয় নানা প্রজাতির মাছে ভরপুর বনটি। স্থানীয় জেলেরা এ বনের মধ্যে নানা প্রকার ফাঁদ পেতে মাছ শিকার করে। বনের মধ্যে ঘুরাঘুরির সময় নি:শব্দ ভেদ করে জেলেদের সাংকেতিক শব্দে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নানা প্রকার কীটপতঙ্গ খেতে বনের মধ্যে ভিড় জমায় মাছের দল। সবমিলিয়ে নিজের সবকিছু নিয়ে বনটি যেনো এক তৃপ্ত সুখীর প্রতিচ্ছায়া। এ বনটির ব্যাপক প্রচার ও যাতায়াতের উন্নতি ঘটালে এটি হয়তো পর্যটকদের কাছে এক আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হতে পারে।
বুজিরবন সম্পর্কে জৈন্তাপুর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, রাতালগুলের মতোই এ বনটি। এটা নতুন পর্যটন স্পট হিসেবে বেছে নিতে পারেন প্রকৃতিপ্রেমিরা। এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় এর পরিচিতি খুব একটা নেই। ভ্রমণের জন্য এ স্থান পছন্দের তালিকায় রাখতে পারেন পর্যটকরা। তবে ঠিক কতটুকু জায়গা নিয়ে ‘বুজিরবন’ নিজের রূপ-লাবণ্য মেলে ধরেছেÑআপাতত এমন তথ্য পাওয়া যায়নি উপজেলা প্রশাসন থেকে।