অনেক আগে থেকেই ওলী-আউলিয়ার অঞ্চল সিলেটকে ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ফলে এ অঞ্চলে ভূমিকম্প নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা; বাড়ছে আতঙ্ক। শনিবার (২৯ মে) সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে সিলেটে প্রথম ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এরপর আরও ৪ দফা ভূমিকম্পে কাঁপায় আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটকে।
চার দফার এই ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ১। শনিবার বেল ১টা ৫৮ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে আবারও ভূমিকম্পে আঘাত হানে। যার মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪। একদিনে বারবার ভূমিকম্পে আঘাত আনায় সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক দেখা দেয়।
তবে এ ভূমিকম্পে কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। ভূমিকম্পের উৎপত্তি ছিল সিলেটের জৈন্তাপুরের সারিঘাট এলাকায়; বার্তাবাহককে এমনটা জানান সিলেট আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী। রোববারও (৩০ মে) ভোর ৪টা ৩৫ মিনিটে সিলেটে আবারও ২ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভ‚ত হয়েছে।
এদিকে শনিবার (২৯ মে) বারবার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় জরুরি সভার আয়োজন করে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। ফায়ার সার্ভিস ও বিদ্যুৎ বিভাগ নিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশন শনিবার বিকেল ৪টায় নগরভনে জরুরি বৈঠকে বসে। এ জরুরি সভার আহবান করেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সিসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী বার্তাবাহককে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত ১০০ বছর পরপর বড় ধরণের ভূমিকম্প আঘাত হানে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে। ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পে ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল পুরো সিলেট। ইতিমধ্যে সেই ঘটনার ১০০ বছর অতিক্রম হয়েছে। এ কারণে সিলেটে বড় ধরণের ভূমিকম্পের শঙ্কাও রয়েছে। শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত করলে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার ভবন ধসে যাবে!
বিভিন্ন গবেষণা আর বিশেষজ্ঞদের মতামত থেকে আসা শঙ্কার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই বিলাস বহুল অট্রালিকা তৈরিতে বিশেষজ্ঞরা সচেতন হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে নগর কর্তৃপক্ষও সিলেট শহরে বহুতল ভবন নির্মাণে সতর্ককতা অবলম্বনের তাগিদ দিয়েছেন। ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ খ্যাত সিলেটে ৭ মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হলে ধসে যাবে প্রায় ৩০ হাজার ভবন; এমন অভিমতই দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাই এ অঞ্চলে ঘন ঘন ও বড় ধরণের ভূমিকম্পের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় ভূমিকম্প নিয়ে সিলেটবাসীর মাঝে বরাবরই ভয় আর আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে দুর্যোগ মোকাবেলার পর্যাপ্ত সক্ষমতা ও প্রস্তুতি নেই সিলেটে।
এছাড়া মহানগরে ‘অট্রালিকা’ তৈরিতে মানা হচ্ছে না ‘বিল্ডিং কোড’ও। আর এসব কারণেই সিলেটে ভবিষ্যতে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে বড় ধরণের বিপর্যয় দেখা দিতে পারেÑএমন আশঙ্কার কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেক আগেই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে সিলেটকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ কারণে এক সময় এ অঞ্চলে ‘একতলা টিনশেড’ ঘর নির্মাণ করা হতো। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ থেকে ক্ষয়ক্ষতি কমাতেই এমন বাড়ি-ঘর তৈরি করা হতো।
কিন্তু এখন নির্মাণ প্রযুক্তি উন্নত হওয়ায় এবং সময়ের বিবর্তনে মানুষ বহুতল ভবন নির্মিাণে আগ্রহী হয়ে ওঠছেন। তাও আবার বিল্ডিং কোড না মেনে। এটা যেনো এখন প্রতিদ্ব›িদ্বতায় রূপ নিয়েছে। নগরসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে অনেক ভবন মালিক ‘বিল্ডিং কোড’ না মেনে গড়ে তুলছেন বহুতল ভবন কিংবা অট্রালিকা; যা এখন ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুতল ভবন নির্মাণে ভবন মালিকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভূকম্পন বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেটের অতি কাছে ডাউকির ওপরে ভূফাটল রয়েছে। যা ‘ডাউকি ফল্ট’ হিসেবে পরিচিত। এই ফল্টই ভূমিকম্পের উৎস। আর এই কারণেই সিলেটকে ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সিসমিক ম্যাপে বাংলাদেশের ভূমিকম্পকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যেমন প্রবল, মধ্যম ও নিম্ন। সিলেটকে ‘প্রবল ভূমিকম্পপ্রবণ’ বা ‘ডেঞ্জার জোন’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ কারণেই সিলেট বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের তালিকায় উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ভূতাত্তি¡ক জরিপ অধিদফতর (সিডিএমপি)’র এক জরিপ অনুযায়ী বড় ভূমিকম্প হলে সিলেট শহরে ৩০ হাজারের বেশি ভবন ধসে পড়তে পারে। তবু সিলেটের বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ হচ্ছে না। শতাধিক ভবন আশঙ্কাজনক হলেও সেগুলো মানুষের বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্য চলছেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং নিয়ম ভেঙে যত্রতত্র সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ফলে ৭-এর অধিক মাত্রার ভূমিকম্পে ধংসস্তুপে পরিণত হবে সিলেট নগর। এতে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে কয়েক হাজার কোটি টাকার; সেই সঙ্গে প্রাণহানি ঘটবে লাখ লাখ মানুষের। জরিপের তথ্য দেখে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বিল্ডিং কোড অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
২০০৬ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক জরিপ থেকে জানা গেছে, সিলেট নগরে শতাধিক প্রাচীন ভবন রয়েছে। যেগুলো একশ থেকে দেড়শ বছরের পুরনো। এসব ভবন ভূমিকম্পের মারাত্মক ঝুঁঁকিতে আছে। সিলেট নগরীতে ‘বিল্ডিং কোড’ না মেনে ভবন নির্মাণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিষয়ে সিসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিধায়ক রায় চৌধুরী বার্তাবাহককে বলেন, বড় ধরণের ভূমিকম্প হলে সিলেট নগরে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে এটা বিশেষজ্ঞরা আগ থেকেই জানিয়ে আসছেন।
এজন্য সিসিকের পক্ষ থেকে সরকারি-বেসরকারি বহুতল বিল্ডিংগুলো ‘কোড’ মেনে বহুতল ভবন তৈরির জন্য আমরা মাঝে-মধ্যে নোটিশও দেই।
সিলেট আবহওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বার্তাবাহককে বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট অঞ্চল হচ্ছে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সিলেটের উত্তরে রয়েছে ডাউকি ফল্ট ও পূর্বে বার্মিক আর্ক। এ জন্য সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।