বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

আপন দৃষ্টি-৪৪

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর রাজনীতি

আব্দুল মালিক

  • সাংবাদিক ও কলাম লেখক
  • ১২:০৯ পূর্বাহ্ণ, ১৫ আগস্ট ২০২০

১৫ ই আগষ্ট, জাতীয় শোকদিবস। দিবসটি মানেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের শহীদ সদস্যদের স্মরণ করা। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ও তাঁর জীবন ধারা সম্পর্কে পুণ:আলোচনা। আজ লেখার শুরুতেই সবাইকে একটি কথা বলতে চাই। জীবনে অনেক বই পড়েছেন, যদি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি না পড়েন তাহলে আপনার বা আপনাদের বই পড়াই বৃথা। অনুরোধ করবো একবার হলেও বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে নেওয়ার জন্য। এ বইটি শুধু বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীই নয়, এটি একটি ইতিহাস। একটি রাজনৈতিক দর্শন।

আমি বলতে চাই বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী বইটি পড়ুন, তারপর রাজনীতি নিয়ে কথা বলুন। বাংলাদেশে এখন শতকরা ৯৫ জন রাজনীতি করেন এবং শতকরা ৮০ জন রাজনীতিকে টাকা উপার্জনের একটা উত্তম উপায় মনে করেন। বর্তমান আওয়ামী লীগের শাখা প্রশাখা এতই বেশি হয়েছে যে, আমার মনে হয় বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ডে শাখা প্রশাখা আছে। এছাড়াও রয়েছে সহযোগি সংগঠনের শাখা। অন্যান্য দলের হিসাব নাইবা করলাম। আমি এই রাজনীতির জোয়ারকে সাধুবাদ জানাই। তবে এর জন্য চাই রাজনৈতিক চর্চা ও অনুশীলন।

বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও প্রতিটি সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীদের জন্য বঙ্গবন্ধুর অমাপ্ত আত্মজীবনী পড়া আবশ্যক। আমার বিশ্বাস যে কেউ বঙ্গবন্ধুর অমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে রাজনীতির মাঠে কাজ করেন তাহলে ওই রাজনীতিক অর্থ উপার্জনের পথ না ভেবে বঙ্গবন্ধুর মতো রাজনীতিকে মানুষের সেবা মনে করবেন।

এই একটি মাত্র বই বঙ্গবন্ধুর অমাপ্ত আত্মজীবনী মানুষের রাজনৈতিক চরিত্র গঠনের কারিগর বলেও আমি মনে করি। সেই সাথে এ বইটিকে বাংলাদেশের পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত অবশ্যই আবশ্যক করার জন্য আহবান জানাই। আজ কাল সবাই একটা সহজ কথা বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। বঙ্গবন্ধু নিয়ে দেশকে যে মহা-পরিকল্পনা করেছিলেন, সেটিই ছিল বাকশাল।

আজ আমি বাকশাল কি আলোচনা করতে চাই

বাকশালকি ?
স্বাধীনতা বিরোধী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকরা বঙ্গবন্ধুকে তাচ্ছিল্য করতে বরাবরই ‘বাকশাল’ শব্দটা ব্যবহার করে। নিশ্চিত জানি, তারা অনেক কিছুরমত শুধু এই শব্দটিই জানেন। শব্দটির বানান জানে কিন্তু আর কিছুই জানেনা। শুধু মুখস্তবুলি আউড়ে যান। দু:খজনক হলেও সত্য, এই জানার ঘাটতিটা স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির মধ্যেও প্রবল। এমনকি খোদ আওয়ামী লীগের অনেকেই বাকশাল সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখেন না। স্বাধীনতা যদি বিপ্লব হয় তবে সেই স্বাধীনতার ধারাবাহিকতায় এসেছে বাকশাল। হঠাৎ করে নয়। প্রথম বিপ্লব, স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক মুক্তি। দ্বিতীয় বিপ্লব, অর্থনৈতিক এবং সাধারণ মানুষের মুক্তি। চীন-রাশিয়া বাদ দিলাম, কিউবায় ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ইমাম খোমেনীও বিপ্লবের রেশ বজায় রাখতে একদলীয় শাসন ব্যবস্থাই চালিয়ে গেছেন বহুকাল। তাঁদের সবাইকে দেশগড়ার কারিগর বলা হলেও বঙ্গবন্ধুকে নয় কেন?

আসুন বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের আলোকেই জেনে নেই ‘বাকশাল কি?’

আবীর আহাদ নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণার কিছু দিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এখানে সেই সাক্ষাৎকারটির নির্বাচিত অংশ বিশেষ উদৃত করা হলো :

আবীর আহাদ : বঙ্গবন্ধু আপনার রাজনৈতিক চিন্তা ধারার মূলনীতি বা লক্ষ্য কি?

বঙ্গবন্ধু : আমার রাজনৈতীক চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণার উৎস বা মূলনীতি হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। এই চার মূল নীতির সমন্বিত কার্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি শোষণহীন সমাজ তথা আমার দেশের দীন-দুখি, শোষিত-বঞ্চিত, শ্রমজীবী-মেহনতি জনগোষ্ঠির মৌলিক অধিকার ও তাদের সমষ্টিগত প্রকৃত ‘গণতান্ত্রিক এক নায়কতান্ত্রিক’ শাসন প্রতিষ্ঠা করণই আমার রাজনৈতিক চিন্তা ধারার একমাত্র লক্ষ্য।

আবীর আহাদ : গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকি পাশাপাশি চলতে পারে ?

বঙ্গবন্ধু : যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে তাকে সংখ্যালঘু ধনীক শোষকদের গণতন্ত্রবলাই শ্রেয়। এর সাথে সমাজতন্ত্রের বিরোধ দেখা দেয় বৈকি। তবে গণতন্ত্র চিনতে এবং বুঝতে আমরা ভুল করি। এর কারণ ও অবশ্য আছে। আর তা হল শোষক সমাজ গণতন্ত্র পূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করুক তা চায়না এবং গণতন্ত্রকে কিভাবে নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থচরিতার্থ করার হাতিয়ারে পরিণত করা যায়, এখানে চলে তারই উদ্যোগ আয়োজন। এভাবেই প্রকৃত গণতন্ত্রকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণ জনগণই শুধু নয়, তথাকথিত শিক্ষিত সচেতন মানুষেরাও প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে বুঝতে অক্ষম। এরা ভাবে যে ভোটাভোটিই হল গণতন্ত্র।

একটু তলিয়ে দেখে না প্রাপ্ত বয়ষ্ক মোট কত পার্সেন্ট ভোট দিল, কোন শ্রেণীর লোকজন নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হল। কারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলো, ক্ষমতাসীনেরা কোন পদ্ধতিতে তাদের শাসন করছে। সাধারণ জনতা কতটুকু কি পাচ্ছে। সুতরাং আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, প্রচলিত গণতন্ত্রের বদৌলতে মাত্র ৫% লোকের বা প্রভাবশালী ধনীক শ্রেণীর স্বৈরাচারী শাসন ও বল্গাহীন শোষণ কার্যের পথই প্রশস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রচলিত গণতন্ত্রের মার প্যাঁচে নিম্নতম সংখ্যালঘু জণগোষ্টির শাসন ও প্রভাব প্রতিপত্তি সর্ব প্রকার দুর্নীতি, অবিচার-অত্যাচার ও প্রতারনায় সমাজের সর্ববৃহত্তম দূর্বল মেহনতী কৃষক-শ্রমিক সাধারণ জনগোষ্টির (শতকরা প্রায় ৯৫%) মৌলিক মানবাধিকার এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। তারা বঞ্চিত হচ্ছে।

প্রকৃত গণতন্ত্র বলতে আমি এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝি, যে ব্যবস্থায় জণগণের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বৃহত্তর কল্যাণের নিমিত্তে তাদের জন্য, তাদের দ্বারা এবং তাদের স্বশ্রেণীভুক্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকার প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে তাদেরই প্রকৃত শাসন ও আর্থ-সামাজিক মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থা প্রচলিত গনতান্ত্রিক উপায়ে অর্জিত হতে পারে না। কারণ প্রচলিত গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে চলে অর্থ-সম্পদের অবাধ ও মুক্ত প্রতিযোগিতা।

এ ক্ষেত্রে দরিদ্র জণগণের পক্ষে এ ধরণের আর্থ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিই এদেরকে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের কার্যকরি নিশ্চয়তা দিতে পারে-তাদের আর্থ-সামাজিক তাদের মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ জন্য আমি মনে করি প্রকৃত গণতন্ত্রের আরেক নাম সমাজতন্ত্র। এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যেই প্রকৃত গণতন্ত্র নিহিত। এ জন্যই আমি গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছি। আমি মনে করি প্রকৃত গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে কোন বিরোধ নেই।

আবীর আহাদ : অনেকে বলেন ‘বাকশাল হল আপনার একদলীয় একনায়কতন্ত্র এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার একটি অপকৌশল। এ সম্পর্কে আপনি পরিষ্কার মতামত দিন।

বঙ্গবন্ধু : সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ পুঁজিবাদী সমাজ সভ্যতা ও শোষক পরজীবিদের দৃষ্টিতে ‘বাকশাল ’তো একদলীয় শাসন ব্যবস্থা হবেই। কারণ বাকশাল কর্মসূচির মাধ্যমে আমি সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি বহুজাতিক শাসক, তাদের সংস্থা সমূহের লগ্নি কারবার এবং তাদের এদেশীয় সেবাদাস, এজেন্ট, উঠতি ধনিকগোষ্টির একচেটিয়া শোষণ ও অবৈধ প্রভাব প্রতিপত্তি, দুর্নীতি-প্রতারণার বিষদাঁত ভেঙ্গে দেবার ব্যবস্থা করছি।

এজন্য তাদের আঁ-তে ঘা লেগেছে। বাকশাল ও আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শাসকরা এদেশে গোপনে অর্থযোগান দিয়ে তাদের সেবাদাস ও এজেন্টদের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক কার্যক্রমকে ব্যহত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সভা, সমিতি এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমার সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রাচারে লিপ্ত হয়েছে। কল-কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন থানায় তাদের চরদের দিয়ে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে লুটতরাজ, অগ্নসংযোগ, গণহত্যা, অসামাজিক কার্যকলাপ ও সা¤প্রদায়িক তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রতিদিন তাদের ষড়যন্ত্রের কথা আমার কানে আসছে।

প্রচলিত গণতান্ত্রিক বৈষম্য, শোষণ- দুর্নীতি ভিত্তিক সমাজকে, দেউলিয়া আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে, জরাজীর্ণ প্রশাসন ও অবিচারমূলক বিচার ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটিত করে একটি শোষণহীন, দুর্নীতিহীন, বৈষম্যহীন ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজ বিপ্লবে যারা বিশ্বাসী নন, তারাই বাকাশাল ব্যবস্থাকে একদলীয় স্বৈরশাসন ব্যবস্থা বলে অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছেন।

কিন্তু আমি এই সব বিরুদ্ধবাদীদের বলি, এতোকাল তোমরা মুষ্টিমেয় লোক, আমার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ দুখি, মেহনতি মানুষকে শাসন ও শোষণ করে আসছো। তোমাদের বল্গাহীন স্বাধীনতা এবং সীমাহীন দুর্নীতির মধ্যদিয়ে ব্যক্তি সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অবাধ ও মুক্ত প্রতিযোগিতার হোলিখেলায় আমার দুখি মানুষের সব আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্ন সাধধুলোয় মিশে গেছে। দুখি মানুষের ক্ষুধার জ্বালা ব্যথা বেদনা, হতাশা. ক্রন্দন তোমাদের পাষাণ হৃদয়কে একটুও গলাতে পারেনি। বাংলার যে স্বাধীনতা তোমরা ভোগ করছো, এই স্বাধীনতা, এই দেশ, এই মাটি ওই আমার দুখি মেহনতি মানুষের সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দলোন সংগ্রাম, জীবন মৃত্যুর বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে তোমাদের কতটুকু অবদান রয়েছে তা নিজেদের বুকে একবার হাত দিয়ে চিন্তা করে দেখো। বরং অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার বিরোধীতাই করেছো।

বিদেশি শাসক-শোষকদের সহায়তা করেছো। নিজেদের ঘরে থেকে ভাইয়ের ঘর পুড়িয়েছো। মানুষকে হত্যা করেছো। মা- বোনদের লাঞ্ছিত করেছো, আর কিনা করেছো। এই সব করেছো ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের ঘৃণ্য লক্ষে।
আমার দেশের মাত্র ৫ ভাগ লোক ৯৫ ভাগ লোককে দাবিয়ে রাখছে, শাসন শোষণ করছে। বাকশাল করে আমি ওই ৯৫ ভাগ মানুষের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির ব্যবস্থা করতে চাইছি। এতোকাল মাত্র ৫ ভাগ শাসন করেছে, এখন থেকে করবে ৯৫ ভাগ। ৯৫ ভাগ মানুষের সুখ-দুঃখ-দূর্দশার সাথে এই ৫ ভাগ মিশতে হবে। আমি মেশাবোই।
এজন্য বাকশাল করেছি। এই ৯৫ ভাগ মানুষকে সংঘবদ্ধ করছি তাদের পেশার নামে, তাদের বৃহত্তর কল্যাণের নিমিত্তে, তাদের এককদল বাংলাদেশ কৃষক, শ্রমিক, আওয়ামী লীগ বা বাকশাল। মূলত বাকশাল হচ্ছে বাঙ্গালীর সর্বশ্রেণীর সর্ব¯Íরের গণমানুষের একক জাতীয় প্লাটফর্ম, রাজনৈতিক সংস্থা একদল নয়।

এখানে স্বৈরশাসনের কোন সুযোগ নেই। কারণ বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির সম্মিলিত ও সমষ্ঠিগত শাসন ব্যবস্থায় কে কার উপরে শ্বৈরশাসন চালাবে? প্রত্যেক পেশার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে শাসন পরিষদ গঠন করা হবে। কোন পেশা বা শ্রেণী অন্য পেশার লোকদের উপরে খবরদারি করতে পারবে না। যে কেউ, যিনি জনগণের সার্বিক কল্যাণের রাজনীতিতে তথা সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তিনি এই জাতীয় দলে ভিড়তে পারবেন।

যারা বাকশালকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বলে তাদেরকে স্মরণ করতে বলি, ইসলামে কয়টি দল ছিল? ইসলামী ব্যবস্থায় একটি মাত্র দলের অ¯িÍত্ব ছিল, আর তাহল খেলাফতে রাশেদীন। মার্কসবাদও একটি মাত্র দলের অনুমোদন দিয়েছে। চীন, রাশিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম অথবা অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রে কতটি করে দল আছে? এই সব ইসলামী রাষ্ট্র সমূহকেও বাদদেও, ওখানে মহানবীর ইসলাম নেই।

বস্তুত প্রকৃত গণতন্ত্র ব সমাজবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই একটি একক জাতীয় রাজনৈতিক সংস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। একটি জাতীয় কল্যাণের অভিন্ন আদর্শে, ব্যাপক মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষে একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের পতাকা তলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া গত্যান্তর নেই। কিন্তু বহুদলীয় তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় কোনোভাবেই একটা জাতিকে ঐকবদ্ধ করা সম্ভব নয়। সেখানে বহু দলে জনগণ বহুধা বিভক্ত হতে বাধ্য। আর বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন, পরষ্পর বিরোধী রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানির রাজনীতি দিয়ে জাতির বৃহত্তর কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কোনভাবেই অর্জিত হতে পারেনা। ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় না। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও তাই বলে।

আবীর আহাদ : বাকশালের মূল লক্ষ্য বা এর কর্মসূচি নিয়ে কিছু বলুন।

বঙ্গবন্ধু : বাকশালের মূল লক্ষ্য তো আগেই বিশ্লেষণ করেছি। তবে এক কথায় আমি যা বুঝি তাহল, একটি শোষণহীন, দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ও শোষিতের গনতান্ত্রিক শাষণ প্রতিষ্ঠাকরণ। বাকশাল কর্মসূচিকে আমি প্রধানত: তিনটি ভাগে ভাগ করেছি।

(এক) রাজনৈতিক, (দুই) আর্থসামাজিক, (তিন) প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা।

এক
রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক পেশাভিত্তিক লোকদের জাতীয় দল বাকশালের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা রেখেছি এবং পর্যায়ক্রমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকায় জাতীয় দলের একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। জনগণ তাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করবেন। প্রেসিডেন্ট জনগণের নির্বাচনে নির্বাচিত হবেন। জাতীয় দলের যে কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট পদাধিকার বলে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান হবেন। তিনি জাতীয় দলের যে কোন একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করবেন। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে মন্ত্রীদের নিয়োগ করবেন। সংসদ সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশের স্থানীয় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সর্বস্তরের জনগণের প্রতিনিধিত্ব প্রত্যক্ষভাবে বজায় থাকবে।

দুই
আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক বহুমূখি গ্রাম-সমবায় প্রকল্প। এর মাধ্যমে গ্রামীণ আর্থব্যবস্থায় উন্নয়ন বা স্বনির্ভর ও স্বাধীন গ্রামীন ব্যবস্থা, বিশেষ করে ভূমি সংষ্কারের প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের পূণর্বাসন তথা কৃষকদের হাতে জমি হস্তান্তর, উৎপাদন বৃদ্ধি ও সাম্যভিত্তিক বন্টন ব্যাবস্থা নিশ্চিতকরণ। ভারি শিল্প কারখানা, পরিত্যাক্ত সম্পত্তি, বৈদেশিক বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি জাতীয় করণ করে জনগণের যৌথ শৈয়ার মূলধনে নতুন নতুন কৃষিজাত শিল্প ও অন্যান্য শিল্প কলকারখানা ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা। সীমিত ব্যক্তি মালিকানাকে উৎসাহদানেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থা সমূহ যাতে জনসাধারণ ও তাদের শ্রমিকদের শোষণ করতে না পারে তার ব্যবস্থা থাকবে।

তিন
প্রশাসনিক কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রনালয়, কর্পোরেশন ও বিভাগগুলোর পূণর্বিন্যাস ও পূণর্গঠন তথা মাথাভারী প্রশাসনের উচ্ছেদ সাধন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জেলা গভর্ণর ও থানা প্রশাসনিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা। প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ, মহকুমা ও বিভাগীয় পরিষদকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। জেলা ও থানাগুলো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। গ্রাম সমবায় পরিষদ সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে থানা পরিষদ গঠন করা হবে।

তবে থানা পরিষদের প্রশাসক/চেয়ারম্যান ও জেলা গভর্নর জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে। থানা প্রশাসক/চেয়ারম্যানরা ও জেলা গভর্ণররা জনগণ, স্ব স্ব পরিষদ ও প্রেসিডেন্টের কাছে দায়ী থাকবেন। গ্রাম সমবায় পরিষদ, থানা পরিষদ, জেলা পরিষদ-এর পরেই থাকবে জাতীয় সরকার। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে জাতীয় সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতাকে বিপুলভাবে বিকেন্দ্রিকরণ করে প্রশাসনকে জনগণের দ্বার প্রান্তে পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রশাসনিক আমলাতান্ত্র, স্টিলফ্রেম গতানুগতিক বা টাইপড চরিত্রকে ভেঙ্গে গুড়োগুড়ো করে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। সরকারি কর্মচারিরা এখন জনগণের সেবক।

বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টকে রাজধানীতে বহাল রেখে হাইকোর্ট বিভাগকে আটটি আঞ্চলিক বিভাগে বিকেন্দ্রিকরণের ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে সুপ্রিম কোর্টের অধিবেশন বছরে অন্তত একবার করে প্রতিটি আঞ্চলিক বিভাগে (হাইকোর্ট) বসবে। জেলা আদালতসমূহ বহাল থাকবে। প্রতিটি থানাতে থাকবে একাধিক বিশেষ ট্রাইবুনাল। প্রত্যেকটি আদালতে যেকোনো মামলা ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে মিমাংসা করতে হবে। গ্রামে থাকবে একাধিক শালিস বোর্ড। শালিস বোর্ড গঠিত হবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। শালিস বোর্ড চেয়ারম্যান থাকবেন সরকার নিয়োজিত বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা। এভাবে সুষ্ঠু, ন্যায় ও দ্রুততর গণমুখী বিচারকার্য সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রিকরণ করা হয়েছে।

আবীর আহাদ : অনেকে বলেন, আপনি নাকি কোনো একটি পরাশক্তির চাপের মুখে বা তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাকশাল কর্মসূচি দিয়েছেন এবং এ ব্যবস্থা নাকি সাময়িক কালের জন্য করেছেন, এ বিষয়ে অনুগ্রহ করে কিছু বলবেন কি?

বঙ্গবন্ধু : কারো প্রেশার বা প্রভাবের নিকট আত্মসমর্পন বা মাথানত করার অভ্যাস বা মানসিকতা আমার নেই। এ কথা যারা বলেন, তারাও তা ভালো করেই জানেন। তবে অপপ্রচার করে বেড়াবার বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই, তাই উনারা এ কাজে আদাজল খেয়ে নেমেছেন। করুন অপপ্রচার। আমি স্বজ্ঞানে বিচার বিশ্লেষণ করে, আমার অভিজ্ঞতার আলোকে, আমার দীন-দুখী, মেহনতী মানুষের আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়িত করার লক্ষে আমি বাকশাল কর্মসূচি দিয়েছি। আমি যা বলি, তাই করে ছাড়ি। যেখানে একবার হাত দেই সেখান থেকে হাত উঠাইনা। বলেছিলাম এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো, মুক্ত করেছি। বলেছি শোষণহীন দুর্নীতি মুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলা গড়বো, তাই করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ। কোনো কিন্তু নাই, কোনো আপোষ নাই।

আবীর আহাদ : বাকশাল বিরোধী মহল অর্থাৎ ওই ৫ ভাগ সংখ্যায় অতিনগণ্য হলেও তাদের হাতেই রয়েছে বিপুল সম্পদ। তাদের সাথে রয়েছে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী শক্তির যোগসাজশ। তাদের পেইড এজেন্টরাই রয়েছে প্রশাসনিক ও অন্যান্য গুরুত্ব পূর্ণ ক্ষমতার কেন্দ্রে। তাদের কায়েমীস্বার্থের উপর আপনি আঘাতহানতে যাচ্ছেন, এই অবস্থায় তারা চোখ মেলে, মুখগুজে বসে থাকবে বলে আপনি মনে করেন? তারা তাদের অবস্থান নিরাপদ ও সংহত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে না?

বঙ্গবন্ধু : আমি জানি তারা বসে নাই। ষড়যন্ত্র চলছে। প্রতিদিনই ষড়যন্ত্রের উড়ো খবর আমার কাছে আসে। সা¤্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহীরা এসব ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। গোপন পথে অঢেল অর্থ এ কাজে লাগাবার জন্য বাংলাদেশে আসছে। সুকৌশলে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ চলছে। অপপ্রচার চলছে। আমি জাতির বৃহত্তর কল্যাণে এ পথে নেমেছি। জনগণ সমর্থন দিচ্ছে। তাই ষড়যন্ত্র করে, বাধার সৃষ্টি করে, হুমকি দিয়ে আমাকে নিবৃত্ত করা যাবে না। আমার কাজ আমি করে যাবোই।

হয়তো শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। পরোয়া করি না। মৃত্যু আমার জীবনে অনেকবার এসেছে। একসিডেন্টলি আজও আমি বেঁচে আছি। অবশ্যই আমাকে মরতে হবে। তাই মৃত্যুভয় আমার নেই। জনগণ যদি বোঝে আমার আইডিয়া ভালো, তাহলে তারা তা গ্রহণ করবে। আমার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। আমার একটা বড় শান্তনা আছে, যুদ্ধের সময় আমি জনগণের সাথে থাকতে পারিনি। জনগণ আমারই আদেশ ও নির্দেশে যুদ্ধ কওে দেশ স্বাধীন করেছে। আজকের এই শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্র বা অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লবে আমি যদি নাও থাকি, তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার বাঙালীরা যেকোনো মূল্যে আমার রেখে যাওয়া আদর্শ ও লক্ষ্য একদিন বাংলার বুকে বাস্তবায়িত করে ছাড়বে ইনশাল্লাহ।


অন্যান্য খবর