ঢোল, বাঁশি, করতাল, সানাই; বাংলা সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। সংস্কৃতির একটি অনুসঙ্গও এ গুলো। যাত্রা, নাটক, বাউলগান, পালাগান-পূজাসহ বাংলা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে রেখেছে এ বাদ্যযন্ত্রগুলো।
যে সব যন্ত্রকে লালন করেছেন সিলেট বিভাগের বিশাল এক জনগোষ্টি। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এ যন্ত্রাংশের দাপট যেনো বিলিন হতে চলেছে; বা বিলুপ্তির পথে। সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় শতাধিক পরিবার এ বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এ বাদ্যযন্ত্রকে স্বপ্ন-সাধনা। এটাকে পেশা হিসেবেও নিয়েছেন তারা। কিন্তু কালের বিবর্তনে ‘ঢোল’সহ বাংলা ঐতিহ্য নানা বাদ্যযন্ত্র আজ হারিয়ে যাচ্ছেÑকিংবা এ সংস্কৃতিকে ধরে রাখার তাগিদ্রও যেনো কারোর নেই। প্রযুক্তির চাহিদা বাড়ায় গান-বাজনায় যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। আর কদর কমেছে বাংলার আনাচে-কানাচে বেজে ওঠা ঢোল, বাঁশি, করতাল, সানাইসহ এ যন্ত্রগুলোর।
জানা গেছে, প্রায় ৫০ বছর ধরে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দুবাগ, লাউতার ভাওরাটুল এলাকা ও পৌর শহরের নয়াগ্রামে বসবাস করে আসছেন ঢোল বাঁশি, করতালসহ বাজনার সঙ্গে জড়িত একটি বিশাল জনগোষ্টি। তাদের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন এ বাদ্যযন্ত্র। এ যন্ত্রের ব্যবহারে প্রতিটি দলে কাজ করেন ৬ জন বংশীবাদক, ১ জন বাংলা সানাইবাদক, ১ জন করে জয় ঢাকবাদক, ঢোলবাদক, জুড়িবাদক, কারা বা ছোট জয়ঢাক বাদক আর করতাল বাদক।
নাটক, যাত্রা, বাউলগান, পালাগান, সনাতন ধর্মের বিয়ে, পূজা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ওরস, র্যালিসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের ডাক পড়ে। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজানো বাবদ জনপ্রতি মিলে পান ৫০০ টাকা। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, অগ্রহায়ণ, মাঘ আর ফাল্গুনে তাদের উপার্জন মৌসুম।
এর সঙ্গে জড়িতদের বসতি এলাকায় সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, টিনের ঝুপড়ি ঘরে কোনোমতে বসবাস করছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। নানা কষ্টে দিন কাটছে এ পরিবারগুলোর। বিয়ানীবাজা উপজেলার দুবাগ এলাকার চার সন্তানের জনক ও বয়োজ্যেষ্ঠ বাঁশিবাদক মো. বাদশা বলেন ঢোল, বাঁশি, করতালসহ এ যন্ত্রগুলো আমাদের জাতিগত পেশা।
পূর্বপুরুষ থেকে এ ব্যবসা চলে আসছে। ব্যবসা-বাণিজ্য নেই, তাই খুব অভাবে রয়েছি। বছরের ৬ মাস চলে এ ব্যবসা। যখন কাজ থাকে না তখন পেটের দায়ে রিকশা চালাই। কেউ কেউ আবার হাটে-বাজারে ইঁদুর, তেলাপোকা, পিঁপড়া মারার ওষুধ বিক্রি ও নাপিতের কাজ করে চলে।
বাঁশিবাদক জোয়াদ আলী বলেন, অন্য কোনো কাম জানা নেই বলে কোনো রকমে এ পেশা দিয়ে বেঁচে আছি। নাটক, যাত্রা, বাউলগান, হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ে, পূজা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ওরস, র্যালিসহ বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজাই। তিনি বলেন, বিদেশি বাদ্যযন্ত্রের কারণে আমাদের চাহিদা কমে গেছে। বাংলার ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।
বিয়ানীবাজার উপজেলা সমাজসেবা কমকর্তা অনুজ চক্রবর্তী জানান, বাংলার ঐতিহ্য ঢোল, বাঁশি, সানাই, করতাল যন্ত্রের সঙ্গে যে জনগোষ্টি জড়িত তাদের বসবাসরত এলাকা পরিদর্শন করা হবে। সমস্যা নির্ণয়সহ স্বাভাবিক জীবনযাপনের যথাসাধ্য সহযোগিতার উদ্যোগ নেয়া হবে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় আসা বিভিন্ন প্রকল্পে তাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার কথাও জানান তিনি।