বেশ আগে থেকেই ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে ওলী-আউলিয়ার অঞ্চল সিলেট। এ কারণে এ অঞ্চলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে রয়েছে আতঙ্কও।
মঙ্গলবার ভোর রাতে (সোমবার দিবাগত রাত) ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে পুরো সিলেট। ৩ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলং এলাকা। যা সিলেট শহরের অতি কাছে। এ ভূমিকম্প সিলেটজুড়ে নতুন করে আতঙ্ক বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত ১০০ বছর পরপর বড় ধরণের ভূমিকম্প আঘাত হানে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে। ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পে ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল পুরো সিলেট। ইতিমধ্যে সেই ঘটনার ১০০ বছর অতিক্রম হয়েছে। এ কারণে সিলেটে বড় ধরণের ভূমিকম্পের শঙ্কাও রয়েছে। শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত করলে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার ভবন ধসে যাবে!
বিভিন্ন গবেষণা আর বিশেষজ্ঞদের মতামত থেকে আসা শঙ্কার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই বিলাস বহুল অট্রালিকা তৈরিতে বিশেষজ্ঞরা সচেতন হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে নগর কর্তৃপক্ষও সিলেট শহরে বহুতল ভবন নির্মাণে সতর্ককতা অবলম্বনের তাগিদ দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ২৭ জানুয়ারি সিলেট অঞ্চলে ৪ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। যার উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায়। ওইদিন ভূমিকম্পের সময় সিলেট নগরসহ পুরো অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়।
যদিও এদিন কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ খ্যাত সিলেটে ৭ মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হলে ধসে যাবে প্রায় ৩০ হাজার ভবন; এমন অভিমতই দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাই এ অঞ্চলে ঘন ঘন ও বড় ধরণের ভূমিকম্পের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় ভূমিকম্প নিয়ে সিলেটবাসীর মাঝে বরাবরই ভয় আর আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে দুর্যোগ মোকাবেলার পর্যাপ্ত সক্ষমতা ও প্রস্তুতি নেই সিলেটে।
এছাড়া মহানগরে ‘অট্রালিকা’ তৈরিতে মানা হচ্ছে না ‘বিল্ডিং কোড’ও। আর এসব কারণেই সিলেটে ভবিষ্যতে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে বড় ধরণের বিপর্যয় দেখা দিতে পারেÑএমন আশঙ্কার কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনেক আগেই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে সিলেটকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ কারণে এক সময় এ অঞ্চলে ‘একতলা টিনশেড’ ঘর নির্মাণ করা হতো। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ থেকে ক্ষয়ক্ষতি কমাতেই এমন বাড়ি-ঘর তৈরি করা হতো।
কিন্তু এখন নির্মাণ প্রযুক্তি উন্নত হওয়ায় এবং সময়ের বিবর্তনে মানুষ বহুতল ভবন নির্মিাণে আগ্রহী হয়ে ওঠছেন। তাও আবার বিল্ডিং কোড না মেনে। এটা যেনো এখন প্রতিদ্ব›িদ্বতায় রূপ নিয়েছে। নগরসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে অনেক ভবন মালিক ‘বিল্ডিং কোড’ না মেনে গড়ে তুলছেন বহুতল ভবন কিংবা অট্রালিকা; যা এখন ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুতল ভবন নির্মাণে ভবন মালিকদেও সচেতন হওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভূকম্পন বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেটের অতি কাছে ডাউকির ওপরে ভূফাটল রয়েছে। যা ‘ডাউকি ফল্ট’ হিসেবে পরিচিত। এই ফল্টই ভূমিকম্পের উৎস। আর এই কারণেই সিলেটকে ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সিসমিক ম্যাপে বাংলাদেশের ভূমিকম্পকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যেমন প্রবল, মধ্যম ও নিম্ন। সিলেটকে ‘প্রবল ভূমিকম্পপ্রবণ’ বা‘ ডেঞ্জার জোন’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ কারণেই সিলেট বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের তালিকায় উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ভূতাত্তি¡ক জরিপ অধিদফতর (সিডিএমপি)’র এক জরিপ অনুযায়ী বড় ভূমিকম্প হলে সিলেট শহরে ৩০ হাজারের বেশি ভবন ধসে পড়তে পারে। তবু সিলেটের বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ হচ্ছে না। শতাধিক’ ভবন আশঙ্কাজনক হলেও সেগুলো মানুষের বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্য চলছেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং নিয়ম ভেঙে যত্রতত্র সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ফলে ৭-এর অধিক মাত্রার ভূমিকম্পে ধংসস্তুপে পরিণত হবে সিলেট নগর। এতে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে কয়েক হাজার কোটি টাকার; সেই সঙ্গে প্রাণহানি ঘটবে লাখ লাখ মানুষের। জরিপের তথ্য দেখে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বিল্ডিং কোড অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
২০০৬ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশবিদ্যালয় পরিচালিত এক জরিপ থেকে জানা গেছে, সিলেট নগরে শতাধিক প্রাচীন ভবন রয়েছে। যেগুলো একশ থেকে দেড়শ বছরের পুরনো। এসব ভবন ভূমিকম্পের মারাত্মক ঝুঁঁকিতে আছে।
সিলেট নগরীতে ‘বিল্ডিং কোড’ না মেনে ভবন নির্মাণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিষয়ে সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, বড় ধরণের ভূমিকম্প হলে সিলেট নগরে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে এটা বিশেষজ্ঞরা আগ থেকেই জানিয়ে আসছেন। এজন্য সিসিকের পক্ষ থেকে সরকারি-বেসরকারি বহুতল বিল্ডিংগুলো ‘কোড’ মেনে বহুতল ভবন তৈরির জন্য আমরা মাঝে-মধ্যে নোটিশও দেই।
মহানগরের ভেতরে যাদের ভবনগুলো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, বড় ভূকম্পনে যাদের বিল্ডিং ভেঙে পড়বে এমন আশঙ্কা তাদের নিয়ে নগর কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েক দফা বৈঠকেও করেছে। সেগুলো ভেঙে ‘বিল্ডিং কোড’ মেনে নতুন করে ভবন তৈরি করার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে-যোগ করেন তিনি।
সিলেট আবহওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট অঞ্চল হচ্ছে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সিলেটের উত্তরে রয়েছে ডাউকি ফল্ট ও পূর্বে বার্মিক আর্ক। এ জন্য সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।