শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

আপন দৃষ্টি ৫৮

যুক্তরাজ্যে মুক্তিযোদ্ধা কি ১২ জন?

আব্দুল মালিক

  • সাংবাদিক ও কলাম লেখক
  • ১১:৫২ অপরাহ্ণ, ১৩ জুলাই ২০২১

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাওয়া ১২জনই কি মুক্তিযোদ্ধা? লেখাটা শুরুর আগে প্রশ্নটা এ জন্যই রাখলাম যে দীর্ঘ নয়টি মাস যুদ্ধ চলা অবস্তায় সারা বিশ্বের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্যেকটি বাঙ্গালীর ঘুম সেদিন হারাম হয়ে গিয়েছিল। কারণ সে সময়ের মানুষগুলি শুধুমাত্র ফেলে আসা পরিবারের মা বাবা ভাইবোন ছেলে-মেয়েদের জন্য টাকা রোজগার করতে বিদেশে এসেছিল। যখন এই মানুষগুলো শোনলেন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তখন প্রতিটি মানুষ ঘুম ও নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে পাগলের মত উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন।

যুক্তরাজ্যে বসবাসকারি বাঙ্গালীরা দলবদ্ধ হয়ে সাংগঠনিক ভাবে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে লাগলেন। দেশটির বড় বড় শহর যেমন লন্ডন, বার্মিংহাম, অল্ডহাম ও ব্রাডফোর্ডসহ বিশেষ করে বাঙ্গালীরা যে যেখানে থাকতেন প্রতিটি শহরে সাংগঠনিক ভাবে সংগঠিত হয়ে বাংলার মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার জন্য যা যা করার প্রয়োজন তাই করতে শুরু করেন।

দলবদ্ধ ও সাংগঠনিক ভাবে বিশেষ করে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ডাকে বিভিন্ন শহরের বাঙ্গালী সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরি, মুক্তিযুদ্ধকে আর্থিক সহযোগিতার জন্য চাঁদা তোলা, দুতাবাসের সামনে প্রতিবাদ সভা করতে গিয়ে পাকিস্তানীদের সাথে সংঘর্ষ, গ্রেফতার হয়ে কারা বরণসহ জীবনকে বাজি রেখে পাকিস্তানী গণহত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। সেদিন কোন সম্মাননার প্রত্যাশায় নয়, প্রবাসী বাঙ্গালীরা নিজ পরিবার পরিজনের টানে, স্বদেশ-স্বজাতির ভালবাসার প্রবল আকর্ষণে পাগল হয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে কাজ করেছেন।

আমি আজ যুক্তরাজ্যের সকল শহর নয়, শুধুমাত্র ওল্ডহ্যাম শহরের সেই সময়ের প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটু আলোচনা করব। ওল্ডহ্যাম যুক্তরাজ্যের তৃতীয় ঘনবসতি বাঙ্গালী অধ্যষিত শহর।

১৯৭১ সালে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর সারা বিশ্ব যেমন উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে বাঙ্গালীরা স্বাধীনতা চায়, ঠিক তেমনি ওল্ডহ্যামের বাঙ্গালী যুবকরাও সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন, যুদ্ধ ছাড়া বাঙ্গালীরা স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে না। তাই তারাও প্রতিদিন প্রবল উৎকন্ঠায় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন মিডিয়া থেকে খবর সংগ্রহ করতেন।

২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার সাথে সাথেই যুদ্ধ যখন শুরু হয়। তখন যুক্তরাজ্যে কাচা মিয়া ও মরহুম মকবুল আলীর নেতৃত্বে এক ঝাক তরুণ মিলে সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। ওল্ডহ্যামের হাজী আসদ্দর আলীর ক্যাফিবারে বসে দেশের মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করার জন্য গড়ে তুলেন `ওল্ডহ্যাম বাংলাদেশ ইয়ুথলীগ’।

সেই ইয়ুথলীগের মাধ্যমে তাঁরা বিভিন্ন শহরে গিয়ে সবার সাথে যোগাযোগের জন্য একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করতেন এবং বিশ্বজনমত তৈরি করার জন্য দুতাবাসের সামনে প্রতিবাদ সবায় অংশগ্রহণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। সেই সাথে দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও ঔষধপত্রের সাহায্য করার জন্য চাঁদা তোলতেন। সেই সময় ইয়ুথলীগের সদস্য ফি ছিল ১০ শিলিং। ইয়ুথলীগের সদস্যরা চাঁদা সংগ্রহের জন্য বাঙ্গালীদের ঘরে ঘরে যেতেন, বিভিন্ন ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান এমন কি সিনেমা হলের সামনে দাড়িয়েও পয়সা সংগ্রহ করছেন। ওই মুক্তি পাগল প্রবাসী বাঙ্গলীরা।

সেই সময় ইয়ুথলীগের পক্ষ থেকে যুক্তরাজ্য কাচা মিয়া, ফজলুল হক, আব্দুল হেকিম ও মর্তূজ আলী ১৮শত পাউন্ড তোলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে দেন । নিজের দেশ ও দেশের পরিবারের উপর পাকিস্তানী বর্বর বাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও নিপীড়নের খবর শুনে হৃদয়ে রক্তক্ষরণের ভীষণ যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে পাগল প্রায় এই মানুষগুলো নাওয়া-খাওয়ার কথাও ভুলে যেতেন।

প্রতি রোববার ইয়ুথলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা বসতো। কোথায় কখন কোন দুতাবেসে সবাইকে নিয়ে যেতে হবে, প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে হবে আলোচনা হত। লন্ডন সিটিতে গিয়ে ১০ নাম্বার ডাউনিং স্ট্রীট গিয়ে স্মারকলিপি পেশ, ট্রাফলগার স্কোয়ারে র‌্যালী ও ঐতিহাসিক লন্ডন হাইড পার্কের জনসমাবেশে অংশগ্রহণ করতেন। ওই সকল সভার নেতৃত্বের সামনের সারিতে প্রায় সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন ম্যানচেস্টারের আরেক প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আব্দুল মতিন। প্রতিবাদ সভা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে পাকিস্তানীদের সঙ্গে প্রবাসী বাঙ্গালীদের সংঘর্ষ হতো। এই সংঘর্ষে অনেক সময় অনেক প্রবাসী বাঙ্গালী এরেষ্ট হয়ে কারাবরণ করেছেন।

পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর খবর পেয়ে আনন্দে উল্লাসিত হয়ে দেশে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন অনেকেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সর্ব প্রথম ইউরোপ থেকে চাটার্ট ফ্লাইট চালু হয় এবং এই ফ্লাইটেই যুক্তরাজ্য প্রবাসী কাচা মিয়া ও মকবুল আলীসহ অনেই কলিকাতা হয়ে বাংলাদেশে যান।

সেদিনের সেই সংগ্রামী ইয়ুথলীগ সদস্যদের ৩০ জনের নাম ও সেই সময়ের ঠিকানাসহ একটি তালিকা আমাকে দিয়েছেন প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধা কাচা মিয়া। সেই ৩০ জনের মধ্যে ১১জন এখনও জীবিত আছেন। যেখানে শুধু ওল্ডহ্যাম শহরে ৩০ জন প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা সেখানে সারা যুক্তরাজ্যে মাত্র ১২জনকে কেমন করে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয় সরকার? এরাও আবার যুক্তরাজ্যের প্রথম সারির কোন মুক্তিযোদ্ধা নয়। তারপরও সরকার যখন দিয়েছেন আমরা চাই সবাইকে এই মহান সমানে সম্মানীত করা হোক।

আজ যারা বেঁচে আছেন তারাও একজন একজন করে নিয়তির ডাকে হয়ত একদিন চলে যাবেন। কিন্তু এই জীবিত প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধারা মনে ভীতর ভীষন কষ্ট পেয়ে যাবেন যদি শেখ হাসিনার সরকার তাদেরকে এই মহান বীরমুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান না করেন। যুক্তরাজ্য প্রবাসী বীরমুক্তিযোদ্ধা কাচা মিয়ার বলেন, ‘আমরা কোন ভাতা চাই না, চাই শুধু মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আপনার কাছে বিনীত নিবেদন, যুক্তরাজ্যে প্রকৃত পক্ষে যারা মুক্তিযোদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর ছিলেনই না মন প্রাণ দিয়ে কাজ করেছেন প্রবাসে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে চাঁদা তোলে মুক্তিযুদ্ধকালিন সরকারকে সহযোগিতা করেছেন। তাদের তালিকা করে দলমতের উর্ধে উঠে তাদের মুক্তিযোদ্ধার শেষ বয়সে এসে তারা নিজের দেশকে নিয়ে আরও গর্বিত হবে।


অন্যান্য খবর