আমাদের ঝিগলী, বরাটুকা, আনুজানী ও জাহিদপুরসহ সারা দক্ষিণ ছাতকের মানুষের চলাচল কেমন ছিল সেদিন? লামারসুলগঞ্জ থেকে গবিন্দগঞ্জ কোন রাস্তা ছিল না। এ নিয়ে আজকের এই লেখা। সারা বছরই ছিল নৌকা আর দুটি পা। বর্ষাকালে কিন্তু পা চলত না, নৌকাই ছিল গবিন্দগঞ্জ যাওয়ার একমাত্র উপায়।
সামগঞ্জের (বর্তমান আলীগঞ্জ) বাজার সব গুলো নৌকা বাঁধা থাকত। ১৫/২০জন যাত্রী হলেই মাঝি নৌকা ছাড়তেন, আবার কেউ কেউ পরিবার নিয়ে রিজার্ভ করে গোবিন্দগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতেন। প্রতিটি নৌকায় দুইজন মাঝি থাকতেন, একজন পিছনে খাড়াল (হাল) ধরতেন আর অন্যজন গুন টানতেন।
অর্ধেক পথ যাওয়ার পর খাড়াল ধরা মাঝি গুন ধরে টানতেন, আর গুন ধরে টানা মাঝি খাড়াল ধরতে আসতেন। এককথায় দুজন সমান কষ্টের অংশিদার হতেন। নদীতে স্রোত খুব বেশী হলে উজানে গুন টানতে মাঝিদের খুব কষ্ট হত। তাই তারা উজানে ( গোবিন্দগঞ্জ) যাওয়ার সময় যাত্রীদের সংখ্যা কম নিতেন। আলীগঞ্জ থেকে গোবিন্দগঞ্জ প্রায় ৩/৪ ঘন্টা সময় লাগত।
সিলেট ও ছাতকের কাজ শেষে বিকেলে যখন ফিরতেন তখন ঠিক একইভাবে গবিন্দগঞ্জ এসে আবার নৌকা যোগে বাড়ি ফিরতেন। বিকেলে আসার সময় কিন্তু মাঝিদের কষ্ট কম হত কারণ নদীর স্রোতে ভাটির টানে গবিন্দগঞ্জ থেকে আলীগঞ্জ ১/২ ঘন্টা সময় বা এর কাছাকাছি লাগত। এর পাশাপাশি কিন্তু আমরা লঞ্চে করেও যাতায়াত করতাম। লঞ্চ একটা নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিটি গ্রামের লঞ্চ ঘাটে আসত। সঠিক সময়ে লঞ্চঘাটে এসে উপস্থিত না হলে গবিন্দগঞ্জ যাওয়ার একমাত্র পথ নৌকার বিকল্প ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। সামগঞ্জ (বর্তমান আলীগঞ্জ) সহ দক্ষিণ ছাতকের ব্যবসায়ীরা তাদের মালামাল বহন করতেন নদী পথে।
আমার বড় চাচা মরহুম করামত আলী সামগঞ্জ বাজারের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। আমি যখন খুব ছুট ছিলাম, তখন মনে পড়ে আমার চাচা দুজন মাঝি ভাড়া করে সিলেট কালিঘাট গিয়ে দোকানের মালামাল নিয়ে আসতেন। চাচা যেদিন সিলেট যেতেন এর আগের দিন আমার বিবি, মা ও চাচিদের বলে রাখতেন, শেষ রাতে উঠে বিরুন চালের ভাত খাঁটি ঘি দিয়ে রান্না করে রাখার জন্য। কলাগাছের পাতা দিয়ে প্যাকেট করে গামছা দিয়ে বেঁধে চাচার সাথে দিতেন।
ভোর হওয়ার অনেক আগেই দাদাজির ডাকে বড় চাচাজীর ঘুম ভাঙ্গত। তারপর ফজরের নামাজ পড়েই দোকানের মালামাল কেনার জন্য নৌকা যোগে সিলেট রওয়ানা দিতেন। ৩/৪ ঘন্টা নৌকা চালিয়ে সিলেট কালিঘাট পৌছে বাড়ি থেকে নেওয়া বিরুন ভাত দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করে, দোকানের জন্য মালামাল ক্রয় করে বাড়ির পথে আবার রোয়ানা দিতেন। ৮০ দশকে শুরু হয় ইঞ্জিন চালিত নৌকা। এর পর থেকে বিলুপ্ত হতে থাকে গুন টেনে নৌকা দিয়ে জীবিকা নির্বাহকারী মাঝিদের নৌকার প্রচলন। আমাদের দক্ষিণ ছাতক এলাকার মানুষ এভাবেই সিলেট ও ছাতকে যাওয়া আসা করতেন।
১৯৭৬ সালে ভাতগাঁও ইউনিয়নের সুনামধন্য সামগঞ্জ বাজারের নাম পরিবর্তন করে আলীগঞ্জ করা হয়। যদিও ছুট ছিলাম তবুও মনে পড়ে ওইদিন বাজারের সভায় উপস্থিত ছিলেন, ভাতগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল খয়ের সামছুল ইসলাম, ভাতগাঁও ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড মেম্বার ছাদ মিয়া, দক্ষিণ ছাতকের বিশিষ্ট শালিশ ব্যক্তি মখলিছুর রহমান, শালিশ ব্যক্তি আমার মেজো চাচা শরাপত আলীসহ তখনকার বাজারের সকল ব্যবসায়ী ব্যাক্তিবর্গ।
আমাদের ভাতগাঁও ইউনিয়নের ঝিগলী গ্রামের অত্যান্ত সুনামধন্য ব্যক্তি তিনবারের নির্বাচিত ভাতগাঁও ইউনিয়নের চেয়াম্যান মরহুম আবুল খয়ের সামছুল ইসলামের তিনটি লঞ্চ ছিল। এর মধ্যে লামারসুলগঞ্জ নামে একটি লঞ্চ ছিল। যেটি রসুলগঞ্জ থেকে গবিন্দগঞ্জ পর্যন্ত যাতায়াত করত। আর ছিল আজিজ মঞ্জিল ও রাণী নামে দুটি লঞ্চ পরবর্তীতে রাণীকে বিক্রি করে দেন মন্ডলপুরের আরেক সুনামধন্য ব্যাক্তি মরহুম তছির উদ্দিন সাহেবের কাছে। তছির উদ্দিন সাহেবও চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
আবুল খয়ের সাহেব যদিও একজন প্রবাসী ছিলেন, তারপরও তিনি দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর সারাটা জীবনই তিনি অতিবাহিত করেছেন। তিনি ১৯৭৩ সালে প্রথম চেয়াম্যান নির্বাচিত হন এবং এরপর পরই রসুলগঞ্জ থেকে গবিন্দগঞ্জ রাস্তা করার জন্য কাজ শুরু করেন। তখন কোন রাস্তা ছিল না, তাই শুরুতেই বলেছি কেমন ছিল আমরা দক্ষিণ ছাতকের মানুষ যাতায়াত ব্যাবস্থা? রাস্তা করার জন্য তিনি প্রতিটি গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের সাথে মিটিং করেছেন।
এর কারণ আজকের যে লামারসুলগঞ্জ সড়ক এই সড়কটি আমাদের প্রত্যেকটি মানুষের নিজেস্ব যায়গার উপর দিয়ে হয়েছে। তখন এই রাস্তার করতে গ্রামের কোন গরীব কৃষককে সরকার টাকা দেয় নাই। বিনামূল্যে গ্রামের প্রতিটি কৃষক তাদের জমি দান করেছে। অনেক গ্রামে এই জমির জন্য জনাব আবুল খয়ের সাহেব দক্ষিণ এলাকার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে অনেকের পায়ে হাতে ধরে রাজি করিয়ে সড়কের মাটি কাটিয়েছেন। এ নিয়ে অনেক গ্রামে অনেকের সাথে ঝগড়াঝাটিও হয়েছে। সড়ক নির্মাণের পরও তিনি কাঁচা সড়কের উপর দিয়ে গাড়ি চলাচল নিয়ে তিনি কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
আবুল খয়ের সামছুল ইসলাম সরকারের অনুদানের দিকে না থাকিয়ে বেশিরভাগ সময় নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতেন। তিনি বলতেন লামারসুলগঞ্জ কাঁচা রাস্তায় যদি গাড়ি চলাচল না করে রাস্তার মাটি শক্ত হবে না। তাই তিনি বর্ষাকাল ব্যাতীত প্রায় সারা বৎসরই গাড়ি চলাচল অব্যাহত রাখার জন্য দোলার বাজারে নৌকা দিয়ে ফেরি নির্মাণ করে গাড়ি চলাচল অব্যাহত রাখতেন। তিনি লামারসুলগঞ্জ রাস্তার বেশিরভাগ কালবার্ড নির্মাণের জন্যও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান এবং অধিকাংশ কালবার্ড তাঁরই প্রচেষ্টায় নির্মাণ হয়েছে।
জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালে ধানের শিষ নিয়েও একবার এমপি নির্বাচন করেছেন। এরপর আবার উপজেলা নির্বাচনও করেছেন। আমি যখন মঈনপুর হাইস্কুলের ছাত্র ছিলাম তখন প্রতিদিনই লামারসুলগঞ্জ লঞ্চের মাধ্যমেই স্কুলে যাতায়াত করতাম। তবে আমরা ছাত্রদের জন্য মরহুম আবুল খয়ের ভাড়া ফ্রি করে রেখেছিলেন। – চলবে