শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

লাল কাঁকড়ার দ্বীপ


করোনাকালে কক্সবাজারসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সমুদ্র সৈকতে লাল কাঁকড়ার বিচরণ দেখা গেছে। সাধারণত মানুষের পদচারনায় সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে সমুদ্র সৈকতগুলো। এতে আর ঘোরা ফেরার সুযোগই হয় না লাল কাঁকড়াদের। তবে করোনাকালে একটু ফুসরোত পেয়েই তারা সৈকতের বালিতে এঁকেছে ইচ্ছামতো আলপনা।

ক্রিসমাস আইল্যান্ডে তাদের একেবারে আদি রাজত্ব। জাভা ও সুমাত্রা থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে ভারত মহাসাগরে ভাসছে এই দ্বীপ। অস্ট্রেলিয়ার অধীনে থাকা দ্বীপটি অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় ১৬৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৩৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটিতে বাস করেন প্রায় দুইহাজার অধিবাসী।

দ্বীপটি অস্ট্রেলিয়ার দখলে থাকলেও, বেশিরভাগ বাসিন্দা হলেন এশিয়ান। কয়েক পুরুষ আগে, চীন, ভারত ও মালয়েশিয়া থেকে ভাগ্যান্বেষণে এসে পড়েছিলেন এই দ্বীপে। আর ফিরে যাননি মাতৃভূমিতে। এই দ্বীপেই গড়েছেন নিজেদের ভবিষ্যৎ। দ্বীপের অধিবাসীদের বেশিরভাগই বাস করেন দ্বীপের উত্তরদিকে। সেখানে আছে দ্বীপের রাজধানী ফ্লাইং ফিশ কোভ। ক্রিসমাস দ্বীপটির অনাবিল সৌন্দর্যের আকর্ষণে ছুটে আসেন দেশ বিদেশের পর্যটকেরা। সমুদ্রের কিনারায় থাকা প্রবাল প্রাচীর ও সামুদ্রিক গুহাগুলোর টানে নেমে পড়েন ঘন নীল পানিতে। এই দ্বীপের জঙ্গলে আছে তিরিশটিরও বেশি গুহা।

দ্বীপটির উপকূলের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪৬ কিলোমিটার জুড়ে আছে ক্রিসমাস আইল্যান্ড জাতীয় উদ্যান। জাতীয় উদ্যানে দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রজাতির বিরল উদ্ভিদ, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। কিন্তু উদ্যানের মূল আকর্ষণ হলো লাল কাঁকড়া। তাই ক্রিসমাস আইল্যান্ডের অন্য নাম লাল কাঁকড়ার দ্বীপ। যেন নিজেদের রাজ্য গড়ে নিয়েছে তারা এখানে। জাতীয় উদ্যানের ভেতর মাটিতে গর্ত খুঁড়ে, তার মধ্যে বাস করে কোটি কোটি লাল কাঁকড়া। তবে মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যার জন্য এই দ্বীপের লাল কাঁকড়ারা বিখ্যাত নয়। জঙ্গল থেকে সমুদ্রতটের দিকে তাদের বার্ষিক অভিযানের জন্য কাঁকড়ারা বিখ্যাত। এই দ্বীপে বর্ষা আসে অক্টোবর-নভেম্বরে। তখন জঙ্গল ছেড়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায় প্রায় পাঁচ কোটি লাল কাঁকড়া।

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কাঁকড়াগুলো প্রতিবছরই নির্দিষ্ট কিছু পথ দিয়ে সমুদ্রে যাওয়া আসা করে। তাই কাঁকড়াদের সাগর অভিযানকালে, ওই পথগুলোতে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। কোনো কোনো জায়গায় বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়। কাঁকড়াদের চলাচলে সুবিধার জন্য বানানো হয় কৃত্রিম সেতু। পুরুষ কাঁকড়ারা সবার আগে জঙ্গল থেকে সমুদ্রসৈকতে পৌঁছে যায়। সমুদ্রতটের বালি খুঁড়ে অস্থায়ী বাসা বানায়। বাসা বানানো হয়ে গেলে, দল বেঁধে সমুদ্রসৈকতে আসে নারী কাঁকড়ারা। গোটা সমুদ্রতটের রঙ হয়ে যায় লাল। এরপর কয়েক সপ্তাহ ধরে চলে পাঁচ কোটি কাঁকড়ার প্রজনন পর্ব।

প্রজনন পর্ব শেষ হওয়ার পর, পুরুষ কাঁকড়ারা আবার দলবেঁধে জঙ্গলে নিজেদের বাসায় ফিরে যায়। স্ত্রী কাঁকড়ারা সমুদ্রসৈকতের অস্থায়ী বাসায় অপেক্ষা করে শুভমুহুর্তের জন্য। প্রায় দুই সপ্তাহ পর স্ত্রী কাঁকড়ারা সাগরের অগভীর জলে ডিম পেড়ে ফিরে যেতে শুরু করে জঙ্গলে। ডিম ফুটে জন্ম নেয় কোটি কোটি বাচ্চা কাঁকড়া। পরিণত হওয়ার জন্য ছোট কাঁকড়াগুলো কিছুদিন থেকে যায় সমুদ্রসৈকতে। পানি থেকে খুঁজে নেয় খাবার। এই সময় প্রচুর ছোট কাঁকড়া পাখিদের খাদ্যে পরিণত হয়। তিন চার সপ্তাহ পরে নবীন কাঁকড়ারা দলবেঁধে ফিরে যেতে শুরু করে জঙ্গলে। যেখানে আছে ওদের বাবা মায়েরা। কিন্তু জঙ্গলে প্রবেশ করে নিজেরাই গর্ত খুঁড়ে বানিয়ে নেয় নিজেদের বাসা।

তিনবছর জঙ্গলে থাকবে ওরা। পরিণত হয়ে, তিনবছর পর ওরাও যোগ দেবে বার্ষিক সাগর অভিযানে। অংশ নেবে সৃষ্টির মহাযজ্ঞে। ফিজি বা অস্ট্রেলিয়ার পার্থ থেকে বিমানে করে আসতে হয় ক্রিসমাস আইল্যান্ডে। ভার্জিন অস্ট্রেলিয়া সপ্তাহে দুটি এবং ফিজি এয়ারওয়েজ সপ্তাহে একটি বিমান চালায়, ক্রিসমাস আইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য। সারাবছর প্রচুর পর্যটক এখানে ভিড় করেন। লাল গালিচা পাতা সমুদ্রে ভাসমান এই দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।


অন্যান্য খবর