ভাষা সৈনিক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, স্বাধীন বাংলার প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আমৃত্যু প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুস সামাদ আজাদের ১০২ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে।
সোমবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুর ১২টার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ডের উদ্যোগে জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের ১০২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা, কেক কাটা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার হাজী নুরুল মোমেনের সভাপতিত্বে ও
জেলা মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ডের সভাপতি ওবায়দুর রহমান কুবাদের সঞ্চালনা অনুষ্ঠিত আলোচনা সভা বক্তব্য রাখেন, সুনামগঞ্জ পৌর সভার মেয়র নাবেদর বখত, পাবলিক প্রসিকিউটর(পিপি) ড.খায়রুল কবির রুমেন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হায়দার চৌধুরী লিটন, মুক্তি যুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম সিরাজ প্রমুখ।
পরে কেক কাটা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
আব্দুস সামাদ আজাদ ছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলেন। প্রাক্তন এমপি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ৫ম সংসদের বিরোধী দলীড উপনেতা।
তিনি ১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলায়, ভুরাখালী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শরীয়ত উল্লা। সামাদ আজাদ শরিয়ত উলাহর ৫ম পুত্র। সামাদ আজাদ প্রথমে গ্রামের বিদ্যালয়ে ও পরে দিরাই উপজেলার জগদল ভাটিরগাঁও বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষের পর ১৯৪৩ সনে তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক এবং ১৯৪৮ সনে সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও ইতিহাস শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও ইতিহাস বিষয়ে তিনি এম এ পাশ করেন। তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণে সরকার তার এম এ ডিগ্রি কেড়ে নেয়া হয়।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ :
১৯৪০ সালে সামাদ আজাদ সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি হিসাবে ছাত্র রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। তখন তিনি সুনামগঞ্জ সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও ইতিহাস বিষয়ে তিনি এম এ পাশ করেন। তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণে সরকার তার এম এ ডিগ্রি কেতে নেয়া হয়। তিনি ১৯৪৪-৪৮ সাল পর্যন্ত সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করতে গিয়ে কারা বরণ করেন তিনি। ১৯৫৩ সালে তৎকালিন পূর্ব পাকিন্তান যুব লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত পূর্বপাকিস্তান (বাংলাদেশ) আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন। ১৯৫৬ সালে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়ায় পাক সাময়িক সরকার পুনরায় তাকে আটক করে কারাগারে পাঠায়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারীর পর তিনি আবার গ্রেফতার হন এবং ৪ বছর কারাভোগ করে ১৯৬২ সালে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সৃষ্ট ষড়যন্ত্রমূলক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করতে গিয়ে কারারূদ্ধহন।
১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্যনির্বাচিত হন আব্দুস সামাদ আজাদ। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি সুনামগঞ্জ জেলার ২ ও ৩নং আসন জগন্নাথপুর-দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-৩ আসন এবং দিরাই-শালা-ধর্মপাশা ও জামালগঞ্জ-২, দুটি আসনে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার (স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার) প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। আব্দুস সামাদ আজাদ মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা (পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা) এবং ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সামাদ আজাদ বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বপান। ১৯৭১ সালের হাঙ্গেরি বুদাষ্টে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন এবং বিশ্ব বর্ণবৈষম্য কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই দলের মনোনয়নে সংসদ সদস্যনির্বাচিত হন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্বপালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন।