সিলেট। কেউ চেনেন পুণ্যভূমি, কারও কাছে পর্যটন শহর আবার কেউ কেউ ডাকেন দ্বিতীয় লন্ডন। তবে যে নামেই সিলেটকে ডাকা হোক না কেনো সিলেটে রয়েছে আলাদা ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। এমনকি সিলেটীদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও বর্ণ। সম্প্রীতির শহর সিলেট প্রবাসী অধ্যুষিত হলেও রয়েছে স্থানীয় অর্থনীতি। পর্যটন আর পাথরই এ অর্থনীতির মূল উৎস।
তবে হযরত শাহজালাল (র.), হযরত শাহপরাণ (র.)সহ ৩৬০ আউলিয়া ও শ্রী চৈতন্য’র স্মৃতি বিজড়িত সিলেট ব্রিটিশ আমল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এরপর মহান ভাষা আন্দোলন কিংবা স্বাধীনতার যুদ্ধেও সিলেটের রয়েছে বিশেষ অবদান। আর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী তো সিলেটেরই সন্তান। আর দেশ স্বাধীনের পর দেশের অর্থমন্ত্রীর চেয়ারও সিলেটীদের দখলে ছিল বেশি।
এছাড়া দেশের প্রায় ৮০ ভাগ পাথরের যোগান হয় সিলেট থেকে। সিলেটে সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর এবং কানাইঘাটে রয়েছে পাথর খনি। স্থানীয়ভাবে এসব পাথরের খনিকে ‘কোয়ারি’ বলা হয়ে থাকে। এসব কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন করে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়।
পিছিয়ে নেই পর্যটন খাতেও। তবে সিলেটে পর্যটনের ওপার সম্ভাবনা থাকলেও অবকাঠামো উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে। সেজন্য প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পর্যটনস্পট তৈরি হলেও বাড়েনা সুযোগ-সুবিধা। তবুও প্রকৃতির টানে কিংবা স্বচ্ছজলে গা ভাসাতে প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা ভিড় করেন প্রকৃতি কন্যা জাফলং, বিছনাকান্তি কিংবা কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথরে। এসব স্পটের মূল আকর্ষণ ভারত থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ আর শীতল জল। এর বাইরের পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে দেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল। এখানে বর্ষা মৌসুমে পর্যটকদের আনাগোনা বেশি হয়।
এদিকে সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় চা বাগান থাকলেও সিলেট শহরে আছে উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন চা বাগান মালনীছড়া। প্রায় ১৫০০ একর জায়গার ওপর ১৮৪৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া আছে লাক্কাতুরা চা বাগান, মালনীছড়া, আলীবাহার, ডালিয়া, খাদিম, তারাপুর চা বাগান। এসব বাগানে প্রতিদিন মানুষ ঘুরতে আসেন। সবুজ পাতা আর মায়াবি টিলায় বিকেলের অবসর সময় কিংবা সূর্যাস্ত দেখতে প্রতিদিনই মানুষ ভিড় করেন এসব চা বাগানে।
আর হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহপরাণ (র.) এর মাজার জিয়ারতেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন। বিশেষ করে শাহজালালের বার্ষিক ওরসে লাখ লাখ ভক্ত আশেকান মাজারে ভিড় করেন। আর প্রত্যেক বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ওরফে তো ভিড় থাকেই। এছাড়া নগরীর প্রবেশ মুখে আছে ব্রিটিশ স্থাপত্য ক্বিন ব্রিজ, আলী আমজাদের ঘড়ি। আছে জালালাবাদ পার্ক, ওসমানী শিশু পার্ক ও ওসমানী জাদুঘর।
এছাড়াও সিলেটে হচ্ছে দেশের প্রথম হাইটেক পার্ক। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে এ পার্কের কাজ দ্রুত চলছে। আগামী কয়েকমাসের মধ্যে পার্কের কাজ শেষ হবে। এটির কাজ সমাপ্ত হলে এখানে প্রায় ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। এছাড়া নির্মাণাধীন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ঢাকা-সিলেট ছয় লেন সড়ক, সিলেট ন্যাচারাল পার্ক, নগরীর চৌহাট্টায় ২৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের কাজ চলছে। আর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে তৈরি সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার উদ্বোধন করা হয়।
আর দেশের প্রথম ডিজিটাল সিটির তকমাও পেয়েছে সিলেট। চারদিকে সিসি ক্যামেরা বেষ্টিত এ শহরে দেয়া হচ্ছে বিনামূল্য ওয়াইফাই সেবা। এ শহরেই দেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ লাইন নেয়া হয়েছে। এটির কাজ এখনো চলমান আছে। তবে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সিলেট সিটিতে সকল বিদ্যুতের লাইন ভূগর্ভে নেয়া হবে। এতে করে সিলেটে বদলে যাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের চিত্র।
সব মিলিয়ে পাথর আর প্রকৃতি কন্যা সিলেটেও লেগেছে তথ্য প্রযুক্তি ছোঁয়া। এতে করে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে সিলেট। পরিকল্পনাধীন ও নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন একই সঙ্গে পর্যটন কেন্দ্রে অবকাঠামো উন্নয়ন করলে পুরো সিলেটের চিত্রই বদলে যাবে। এতে করে বাড়বে কর্মসংস্থান, কমবে সেবা প্রাপ্তির ভোগান্তি।