শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

স্মৃতি হাতড়ানো বেলাভূমি কক্সবাজার

চন্দ্রা রাহমান

  • লেখক : মুক্তচিন্তা
  • ৫:১২ অপরাহ্ণ, ২৯ মে ২০২০

নানান ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে তারপর হঠাৎ করেই কক্সবাজার যাবার দিনক্ষণ ঠিক হলো যেদিন যাত্রা শুরু তার আগের দিনই। যাবার আগের দিন বিকেলে বাচ্চাদের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে দু’জনই বের হই। সেই ফাঁকে বাসের টিকিটও কেটে ফেলি। আমরা কেনাকাটা করে রাত দশটায় বাসায় ফিরি। সকাল সাড়ে সাতটায় বাস। সেই সুবাদে আমাদের বের হতে হবে ঠিক সকাল সাতটায়। রাতেই সবকিছু গোছগাছ করে রাখি যাতে ভোরবেলা কোন তাড়াহুড়ো না হয়। রাতে সবকিছুই গোছানো হয়ে গেলে ঘড়িতে দেখলাম কাঁটায় কাঁটায় রাত দুটো বেজে গেছে। বিছানায় শুয়ে পড়লাম। উত্তেজনায় ঘুম আসছে না দু-চোখে। তারপর কখন যেনো নিদ্রাদেবি প্রসন্ন হলেন, ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম টেরই পেলাম না।

ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাদের তৈরি করে ঠিক সাতটায় আমরা বাস ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ঠিক সাতটায় বিআরটিসির বাস চট্টগ্রামের এর উদ্দেশ্য ছেড়ে দিল। অনেকদিন পর দূরের পথে যাত্রা তাও আবার বাসে। মনটা আনন্দে নেচে গেয়ে উঠলো-
ও আমার ভাই মনে শান্তি নাই, সবাই যায় সুখের নিদ্রা আমার নিদ্রা নাই। যাই যাই যাই সমুদ্রে যাই।

দিনের বেলায় বাস যাত্রায় পেরিয়ে যাওয়া নিত্যনতুন জায়গাগুলো দেখতে পারছিলাম। নিজের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমার দু-চোখে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। আর মনে হচ্ছিলো আল্লাহ যেনো এভাবেই সবসময় বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার তৌফিক দেন।

আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে… এরইমধ্যে পেট জানান দিল শুধু আনন্দ করলেই চলবে? এইদিকে যে একমুঠো দানা পানি পেটে পড়েনি তার কি খেয়াল আছে। হঠাৎ খেয়াল হলো হ্যা তা-ই তো সকাল থেকেই তো কিছুই খাইনি। পেটের ভিতর যুদ্ধের ডামাডোল বেজে উঠল। মনে হচ্ছিল বাস যে কখন হাইওয়ে রেষ্টুরেন্ট খুঁজে পায়। এরই মধ্যে একবার জ্যামে আটকা পড়ে বাস, আর সেই সুযোগে হকাররা উঠে বাসে। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক বারোটা বাজে। এতো বেলা তার উপর পেটে দানাপানি কিছুই পড়েনি। তাই পপকর্নওয়ালাই ভরসা এই মুহূর্তে। পপকর্ন খেয়ে পানি গিলে কিছুটা ক্ষিধে মিটানোর চেষ্টা।

এবার বলি যাত্রাপথের অনিবার্য অপ্রত্যাশিত অনুষঙ্গের কথা। বড়ো আর ছোট মেয়েটা পুরো যাত্রা পথে বমি করতে করতেই এসেছে। ছোট মেয়েটাকে ওর বাবাই সামলেছিল। আমার কিছুই করতে হয়নি। ও এতটুকু বিরক্তি প্রকাশ করেনি কিংবা রাগ ও করেনি। লাগেজগুলোও উনি আনন্দের সাথেই বহন করেছেন।
আমাদের বাস কুমিল্লা হাইওয়ে এসে কিছুক্ষনের জন্য যাত্রা বিরতি দিল। হোটেলটা দেখতে তেমন একটা পরিচ্ছন্ন না।যেহেতু প্রচন্ড ক্ষিধেয় পেটে জ্বালা পোড়া শুরু হয়েছে সেহেতু সবার অনুমতি নিয়েই স্বামীজি ভাতের ব্যবস্থাই করলেন। কথায় বলে না প্রবাসে নিয়ম নাস্তি। এই মুহূর্তে ধরে নিই- এক জেলার মানুষ অন্য জেলায় যাওয়া মানেই প্রবাস যাত্রা। যাইহোক মুরগীর তরকারী আর ডাল দিয়েই গোগ্রাসে গিলেছি। কি রকম হলো তা আর নাইবা বললাম। পাঠকগন এমনিতেই বুঝতে পারবেন যাদের আমার চেয়েও ঢের অভিজ্ঞতা আছে।

খাওয়া শেষ করে বড়ো মেয়েকে বললাম এর চাইতে তোর মা কত মজা করে মুরগির মাংস রান্না করতে পারে। আর ডালে পাঁচপুরণ দিলে পাড়াপড়শীরা টের পেয়ে যায় যে কিছু হচ্ছে। খাওয়া সেরে আমরা পুনরায় যাত্রা করলাম চিটাগাং এর উদ্দেশ্য। বমি করা ছাড়া বাচ্চাদের নিয়ে আর কোন ঝামেলা পোহাতে হয়নি। সন্ধ্যা সাতটায় আমরা চিটাগাং পৌছাই। সেখানে বাস থেকে নেমে আমরা অটোযান চড়ে আবার কক্সবাজার বাস ষ্টেশনে পৌছাই। বাস না আসা পর্যন্ত সেখানে কিছুক্ষন চা পানের বিরতি দেওয়া হয়।

তারপর আমরা কক্সবাজার পৌছুতে বাসে উঠলাম। বাস রাস্তায় মাঝেমধ্যেই জ্যামে আটকা পড়ে। দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা পর আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌছুতে পারলাম।
বাস থেকে নেমে অটোরিকশা আমাদের কে নিয়ে আদর্শ গ্রামের দিকে ছুটতে লাগলো। কলাতলী বীচ থেকেই খানিকটা দুরেই আদর্শ গ্রাম।

বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। আপা (মানে যে ঘরে উঠব সেই গৃহিনী) আমাদের সাদরে অর্ভ্যথনা জানালেন। সেদিন সরাসরি প্রথম দেখলেও আমার স্বামী আগে থেকেই থাকার সুবাদে আপার সাথে মোটামুটি সখ্যতা ছিল। সবার মিলন মেলায় একটা আনন্দ মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। আপা আমাদের জন্য খাবারের আয়োজনও করেছিল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে ঢোকে দেখি কি সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বিছানা। বিছানা দেখে মনে হলো আহা-রে কত সাধের বিছানা। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে যাচ্ছিল তাই আপার হাতে পরিপাটি বিছানা দেখে মনে হয়েছিলো কতদিন ঘুমাইনি।

আমার একদিনেই এই অবস্থা, আর যারা দিনের পর দিন খোলা আকাশের নিচে, ফুটপাতে, রেলস্টেশনে, শীতের রাতে, খবরের কাগজ বিছিয়ে, পাতলা কাপড় দিয়ে শুয়ে-ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দেয় তাদের কথা আমরা একবারও ভাবি না। কি নিদারুণ কষ্টে তারা দিনযাপন করে তা নিজের চোখে না দেখলে অনুধাবণ করা যায়না। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় আমরা অনেক অনেক ভালো আছি। তবুও আমাদের চাহিদার শেষ নেই।
খাওয়া দাওয়ার পর আপু, দুলাভাই আমাদের রুমে বসে গল্প গুজবে মেতে উঠলেন। হঠাৎ খেয়াল হলো রাত দুটো বেজে গেছে। তারা চলে গেলেন তাদের ঘরে। আমরাও ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।

পরেরদিন ঘুম ভাঙলো সকাল নয়টায়। দেখি সে উঠে তৈরি হয়ে তাঁর অফিসে চলে যাচ্ছে। সেদিন তার একটা ইন্টারভিউ ছিলো। সেজন্যই তাড়াহুড়ো করে আসা। সে চলে যায় আমি বাচ্চাদের নিয়ে সারাদিন বাসায় বসে থাকি। সে আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেলো। বাহিরে বের হই সন্ধ্যা নাগাদ। আমরা কলাতলী বীচের দিকে হাঁটতে লাগলাম। খুব খুবই ভালো লাগল। পুরো একবছর পর আবারও সাগর দেখার সৌভাগ্য হলো। সেখানে আমার স্বামীর সহকর্মীর সাথে দেখা হলো। সবাই কুশলাদি বিনিময় করলাম।

তারপর কেফায়েত ভাইসহ আমরা সবাই কক্সবাজারের ফুচকা, চা খেলাম। ভালোই লাগলো সন্ধ্যেটা। তারপর সবাই মিলে সন্ধ্যা কে আরেকটু উপভোগ্য করার জন্য এবং স্মৃতির মনিকোঠায় ধরে রাখবার জন্য অনেকগুলো ছবিও তুললাম।সেদিন আর বেশি ঘুরাঘুরি করতে পারিনি। তাদের নাকি কাজ আছে। আমাদেরকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে সে চলে যায়।
পরের দিনও সে অফিসে চলে যায়। বিকেলে বের হয়ে বীচের দিকে হাঁটতে লাগলাম। সেদিন আমরা বীচে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখলাম। সূর্যাস্তের পূর্বে বীচে প্রচন্ড ভীড় থাকে। তিল পরিমাণ জায়গা নেই দাড়াবার।

ও হঠাৎ করেই বললো তোমাদের তো আমি সময় দিতে পারছি না, টুরিস্ট পুলিশের গেস্ট রুম খালি আছে কি-না দেখি এসপি সাহেবের সাথে কথা বলে। তাছাড়া এইখানে উঠলে বীচের কাছাকাছি থাকা হলো। একা একাই বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে পারবে। আমিও রাজি হলাম। এসপি সাহেবের সাথে কথা হলো। তিনি আমাদের কথা শুনেই আমার স্বামীকে বললেন, এই কথা আরও আগে কেন বললেন না? তাহলে তো প্রথম থেকেই থাকতে পারতেন। আমাদের গেস্ট রুম দেখানো হলো। খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো।

টিভি, খাট, ড্রেসিং টেবিল, বড়ো কাঠের আলমারি, চেয়ার দিয়ে রুম সাজানো। আমার স্বামী বলেননি যে, আমাদের দুটো রুম লাগবে। এসপি সাহেব নিজে থেকেই আমাদের দুটো রুমেরই ব্যবস্হা করে দিলেন। বাচ্চাদের রুমে রেখে আমরা দু’জনেই বাসা থেকে লাগেজগুলো নিয়ে আসবার জন্য বেরিয়ে পড়লাম।আমাদের বাসা ছিলো কলাতলী বীচের কাছাকাছি আদর্শ গ্রামে।তাদেরকে মানে আপা, দুলাভাইকে বলে আমরা চলে আসি সুগন্ধা বীচে যেখানে টুরিস্ট পুলিশের কার্যালয়। ফিরে আসি গেস্ট রুমে তিন তলায়।

আমাদের রুমে রেখে সে তার সহকর্মীদের সাথে দেখা করতে যায়। বলে যায় ফিরে এসে আমরা রাতের খাবার খাব তৈরি থেকো। রাত দশটায় ফিরে আাসার পর আমরা বের হলাম রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে। বীচ থেকে খানিকটা দূরে নামী-দামী রেষ্টুরেন্ট হান্ডি। হান্ডিতেই আমাদের নৈশভোজের আয়োজন করা হলো। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষ। প্রতিটি খাবারের মান অসাধারণ। হায়াদ্রাবাদী বিরিয়ানির স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। চোখ বুজলে এখনো সেই ঘ্রান নাকে এসে লাগে। বলতে গেলে রেষ্টুরেন্টের সবকিছুই অসাধারণ।

নৈশভোজ শেষ হলে আমরা স্মৃতি ধরে রাখবার জন্য অনেকগুলো ছবি তুললাম। তারপর বীচের উদ্দেশ্য হাঁটতে লাগলাম। বীচে তখন মোটামুটি খুব ঠান্ডা লাগছিলো। আমরা কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করে রুমে ফিরে আসলাম। বাহিরের কাপড় পাল্টাতে যাব আমার স্বামীর অনুমতি নেই। কি রোমান্টিক মোডে আছে কে জানে? আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝেছি এই রাতকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তার এই ভাব। বাচ্চাদের না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না যে সে চার বাচ্চার বাবা। তার হাবভাবপূর্ণ চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে নতুন বিয়ে করেছে।

আমরা এখানে মধুচন্দ্রিমার রাত কাটাচ্ছি। সত্যি ভাবতেই অবাক লাগছে, দু’জনের মধ্যে প্রথম দিনের মতো এতো আবেগ এতো উচ্ছ্বাস আসে কোথা থেকে।আসলে সত্যিকারের ভালোবাসা কখনও পুরনো হয়না। সবসময় নতুনভাবেই উপলব্ধ হয়। আমি আমার স্বামীকে প্রতিদিন প্রতিক্ষন নতুনভাবেই আবিষ্কার করি। সে আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। আমাদেরকে নিয়ে দুরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ায় তার কোন ও ক্লান্তি নেই। সে অনায়াসেই সবকিছুই সামাল দিতে পারে।

পরের দিন বৃহস্পতিবার সে ভোরবেলা উঠেই তাঁর কর্মস্থল টেকনাফ চলে যায়। আমি বাচ্চাদের নিয়েই একা রুমে ছিলাম। বেলা এগারোটা নাগাদ বাচ্চাদের নিয়ে সকালের নাস্তা করতে বেরিয়ে পড়লাম। আমি তাকে ছাড়া অচেনা, অজানা জায়গায় কখনো এভাবে চলিনি।আমার কেমনই যেন মনে হচ্ছিলো সহজ ভাবে চলতে পারছি না তাকে ছাড়া। নাস্তা করে আমরা বীচের দিকে হাঁটতে লাগলাম। বাচ্চারা পানি পেয়ে লাফালাফি করতে লাগলো। দিনটি স্মরণীয় করে রাখবার জন্য আমি তাঁদের কথাগুলো ছবি ও ভিডিও করে রাখি। তারা আনন্দে পানিতে দৌড়াচ্ছে আর আমি সেই ফাঁকে চেয়ার ভাড়া করি। একঘন্টা ভাড়া গুনতে হয় মাত্র তিরিশ টাকা। দুপুর দুইটা পর্যন্ত বীচেই সময় কাটিয়ে দিলাম।

রুমে গিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হতে হতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। পেটে ক্ষুধায় মোটামুটি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তড়িঘড়ি করে নিচে নামলাম, তখন বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ হবে। খাবার শেষ হতেই হতেই সন্ধ্যার কাছাকাছি। এতো কাছাকাছি থাকার পরও সেদিন আর সূর্যাস্ত দেখা হয়নি। সূর্যাস্তের সময় এমন মনে হয় যেনো বড়ো থালার মতো দেখতে সূর্য সমুদ্রের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়।
সন্ধ্যার সময় কিছুক্ষণ বীচে হাঁটাহাঁটি করি। সে ফোন দেয়, বলে ফারুক ভাই (তার সহকর্মী) এর বাসায় আমাদের নৈশভোজের নিমন্ত্রণ।

রাত আটটার দিকে আমরা বের হই ফারুক ভাইয়ের বাসায় যাবার উদ্দেশ্যে। এরই মধ্যে এসপি সাহেবের কল আসে।আমরা আবার পিছনে ফিরে আসি। দোতলায় ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি জনাব জিল্লুর রহমান সাহেবের কার্যালয়। উনার রুমে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। খুবই সুন্দর উনার কার্যালয়। ছিমছাম নীরবতা এক মনোরম পরিবেশ রুমের ভিতরেই বিরাজ করছে। তিনি আমাদের চা,নাস্তা দিয়ে আপ্যায়ন করালেন আর বাচ্চাদের আইক্রিম চকলেট খাওয়ালেন। আমরা প্রায় পৌনে এক ঘন্টা উনার রুমে কাটিয়েছি।

এতো বড়ো মাপের মানুষ, কিন্তু কি অমায়িক ব্যবহার। কয়েকদিন থাকতে পারব না শুনে খুব আফসোস করলেন। বাসায় যাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলেন, কিন্তু থাকতে পারবা না বলে নাকচ করে দিয়েছি। তারপর তিনি তার ব্যক্তিগত গাড়ি চড়ানোর আদেশ দেন। গাড়ির চালক আমাদের লাবনী বীচ থেকে শুরু করে কলাতলী, সুগন্ধা বীচ পিছনে ফেলে অনেকটা দুরেই নিয়ে যান। প্রায় আধা ঘণ্টার উপরে বীচ প্রদক্ষিণ করি।

আনুমানিক সাড়ে নয়টা হবে আমরা ফারুক ভাইয়ের বাসায় পদার্পণ করি। ভাবী মানে উনার স্ত্রী আমাদেরকে পরম মমতায় রিসিভ করলেন। আমরা গল্পগুজবে মেতে উঠলাম। মনেই হচ্ছেনা যে ভাবীকে এই প্রথম দেখলাম। এতো মিশুক আর এতো অমায়িক ব্যাবহার! খুবই ভালো লাগল। ভাবী অনেক কিছুই রান্না করেছিলেন । ভুড়িভোজ করে আমরা চলে আসতে যাব, আমাদের রাতটা তাঁদের বাসায় কাটানোর জন্য খুবই অনুরোধ করেছিলেন ভাই ও ভাবী। কিন্তু আমরা সেই অনুরোধ রাখতে পারিনি। কারন পরের দিনই আমাদের সিলেট চলে আসতে হবে। রাত প্রায় বারোটা নাগাদ তাদের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে আমরা লাবনী বীচে আমাদের রুমে চলে আসলাম।

পরের দিন ছিলো শুক্রবার। সকাল বেলা উঠেই বাচ্চাদের তৈরি করে নিজেরা তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে আমরা রান্নাঘর রেষ্টুরেন্টে গেলাম। সেখান ফারুক ভাই ও ভাবী আর উনাদের ছোট্ট রাজকন্যা জুহায়রিয়া আমাদের সাথে ছিলো। খাবার টেবিলেই ঠিক হলো আমাদের বেড়ানোর গন্তব্য কক্সবাজার বাংলাদেশ বেতার ষ্টেশন। আমরা টমটমে উঠে সবাই বেতার কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বলাবাহুল্য কক্সবাজার হচ্ছে বাংলাদেশের একটি বৃহৎ পর্যটন নগরী ও শিল্প নগরী।

সেখানে প্রতিদিন কতশত দেশি- বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেখানকার রাস্তা ঘাটের কি বেহাল দশা। রাস্তা ঘাট ভাঙ্গা, যেখানে সেখানে ড্রেন ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ এক নগরী। সেইদিকে স কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। যাইহোক, ঝাঁকি খেতে খেতে আমরা পৌঁছে গেলাম সৌন্দর্য মন্ডিত কক্সবাজার বেতার কেন্দ্রে।বিশাল জায়গা জোরে বেতার কেন্দ্র।প্রথম দরজা থেকে কানিকটা ভিতরে সদর দরজা।টিলা বেয়ে উঠতে হয়। চারদিক এতো ছিমছাম নীরবতায় সৌন্দর্য মণ্ডিত পরিবেশ, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় ভরপুর। জীবনে কখনও দেখা হতোনা যদি না আমার স্বামী সেখানে কাজ করতেন। কারণ বিনা অনুমতিতে সেখানে জনসাধারনের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

আমি আমার স্বামীর চাকুরির সুবাদে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট এই চারটি জায়গার বেতারের পরিবেশ দেখেছি। তবে ঢাকার বেতার কেন্দ্রে আমার একটি সরকারী চাকুরীর মৌখিক পরীক্ষা ছিলো, সেই সুবাদে ঢাকার বেতার কেন্দ্র দেখা হয়েছিল। সবচেয়ে বিশাল জায়গা জুড়ে কক্সবাজার বেতার কেন্দ্র অবস্থিত। আমার স্বামী বেতারের সবার সাথেই পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাই আমাদের কে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। সবার অমায়িক ব্যবহারে খুবই মুগ্ধ হয়েছি।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ও আমাদের চোখেমুখে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে।আমরা স্মৃতির মনিকোঠায় ধরে রাখবার জন্য সবাই একই ফ্রেমে বন্দী হলাম।

এক ঘন্টা কিভাবেই যেনো কেটে গেলো তা টেরই পেলাম না। অবশেষে সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ফিরতি পথে যাত্রা করি। পথিমধ্যে বার্মিজ মার্কেট থেকে আমার স্বামী আচার চকোলেট এগুলো কিনে আনেন। আমরা তাড়াতাড়ি করে রুমে ঢোকে আমাদের ব্যাগ গুছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। তখন চারটা প্রায় বেজে গেছে। এদিকে বিকাল পৌনে পাঁচটায় বাসের টিকেট করা। রুমের চাবি তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে আমার স্বামী অভ্যর্থনা কক্ষে গেলেন।

চাবি ফিরিয়ে দেবার সময় ভেবছিলেন রুমের বিলটা পরিশোধ করতে। টুরিস্ট পুলিশরা বললেন আপনারা স্যারের গেস্ট। আর গেস্টদের কাছে থেকে আমরা বিল নেই না। অগত্যা কি আর করা। আমরা টমটম গাড়িতে রওয়ানা দিলাম বাস ষ্টেশনের উদ্দেশ্য। ঠিক সাড়ে চারটায় আমরা ষ্টেশনে পৌছাই। সেদিন ও আমরা দুপুরের খাবারেরও সময় পাইনি। আমার স্বামী গাড়িতে ওঠার আগে পাউরুটি আর কলা কিনে এনেছে। সেগুলো খেয়েই আমাদেট ক্ষুধা নিবারন কিছুটা হলো। তারপরও বাঙালির পেটতো, ভাত ছাড়া চলেই না।

আমাদের কে বিদায় জানাতে আমার স্বামীর সহকর্মী কেফায়েত ভাই বাস ষ্টেশন এসেছিলেন। বাসে উঠে বাস ছাড়বার আগ পর্যন্ত ছিলেন।উনার সাথে আমরা স্মৃতির পাতায় বন্দী হলাম। খুবই খারাপ লাগছে ফিরছি বলে। কারন আমাদের বেড়ানোর চুক্তি ছিলো রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, বায়েজিদ বোস্তামির মাজার। সময় সল্পতার কারনেই আমাদের সে প্ল্যান বাতিল হয়ে যায়। তবে আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখেন পুরো স্বদেশ নিজ চোখে একবার প্রদক্ষিণ করবো এটাই আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ চাওয়া।

আমরা কক্সবাজার থেকে সরাসরি সিলেটের বাসেই রওয়ানা দিই। প্রায় দুই ঘন্টা যাত্রা শেষে চকরিয়া পৌছাই।সান্ধ্যকালীন চা নাস্তা করি। কিন্তু ভাতের মতো পেটের খোরাক মেটানো যথেষ্ট নয়। কথায় বলেনা মাছে ভাতে বাঙালী।
কিছুক্ষন ঘুমিয়ে ছিলাম। প্রায় নয়টার দিকে আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছাই। কিছুক্ষন বিরতি দেওয়াতে খাবার আয়োজনের সুযোগ হলো। ও বিরিয়ানির পেকেট নিয়ে এলো। খাবারের জন্য গাড়ি থেকে আর নামতে হবেনা। ঠিক করলাম কুমিল্লা পৌঁছে আমরা রাতের খাবার খাব। কুমিল্লা পৌঁছাতে ঘড়ির কাঁটা রাত একটায় পৌছাল।গাড়ি প্রায় আধ ঘন্টার জন্য বিরতি দিল। গাড়িতেই আমরা রাতের খাবার সারলাম।

আধোঘুমে আধোজেগে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে চাঁদনী রাতে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চললো আমার প্রানপ্রিয় মাতৃভূমি সিলেটের উদ্দেশ্যে। চাঁদনী রাত আমার কাছে এক মোহনীয় প্রেমময় রাত। সেই রাত আসলেই আমার মনে হয় আমি সেই ভরা যৌবনে ফিরে গিয়েছি। কী যে ভালো লাগছে, কী যে ভালো লাগে- তা বুঝাবার সাধ্য আমার নেই।
আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে যায়। গাড়ি থেকে নেমেছি আমার নিজেকে মনে হচ্ছে পাগলী যেনো। চুলের যে-কি অবস্থা হয়েছে।

বাসায় ফিরে সারারাতের ভ্রমনের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হলাম। চা পান করবো তাই গেলাম রান্নাঘরে। মেঝোসেজো দৌড়ে গিয়ে বলে মা আমরা বাড়ীতে যাব। আমি বললাম সে কী, মাত্র তো এলাম। আঠারো ঘন্টার ধকলই তো সইতে পারলামনা।
ঠিক সকাল দশটায় শশুড় বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।তাড়াহুড়ো করা এ-ই জন্য যে সে আবার পরেরদিন রাতেই ফিরতি গাড়িতে উঠে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে।
শশুড় বাড়ী ঘিলাছড়া যাচ্ছি, যেখানটায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো হাওর হাকালুকি অবস্হিত। আমার বিয়ের পনেরো বছর হয়ে গেলো আমি পুরোপুরি ভাবে হাকালুকি দেখিনি।

রবিঠাকুরের কবিতার মতোই আমারও একই অবস্থা।
‘দেখিতে গিয়াছি পর্বত মালা, দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু।’
প্রথমেই আমরা গেলাম ফুপু শাশুড়ীর বাড়িতে। গিয়ে দেখলাম জীবনের অন্তিমলগ্নে পৌঁছেছেন আমার ফুফা শশুড়। আমাদের দেখে সবাই এতো খুশি হন, কোন ভাষায় প্রকাশ করবো তা আমার জানা নেই।
খাওয়া দাওয়া পর্ব গুছিয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম আমার বড়ো খালা শাশুড়ির বাড়িতে। সেখানেও ফের খাওয়া দাওয়া সারলাম, সৌজন্য সাক্ষাৎ হলো সবার সাথে। তারপর গেলাম আমাদের বাড়িতে। ঢাকার বাসিন্দা আমাদের গ্রামের একাডেমি স্কুলে শিক্ষকতা করেন মাষ্টার সাহেব, তিনি তার পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়িতেই থাকেন। উনারা থাকায় বাড়িটা পরিস্কার পরিচ্ছন্নই থাকে। বাড়িতে গেলে ফিরে আসতে মন চায় না। নানান ধরনের ফলের গাছ, আর পাখপাখালির কলরবে বাড়িটি মোহচ্ছন্ন থাকে।

বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লাম মামা শশুড়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যেখানে যা-ই না কেনো, সবাই-ই এতোই ভালোবাসে তা বলে কিংবা লিখে প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। আমি আমার শশুড় বাড়ির আত্মীয়দের কাছে থেকে বউ হিসেবে যে সম্মান টুকু পাই, তা আমার সারাজীবনের কাহিনী লিখেও শেষ হবেনা। এই লিখা লিখার সময় আমার খালা শাশুড়ীর আর ফুপু শাশুড়ীর আলাদা ভাবে মায়ার কথা মনে পড়ছে।

অনেককিছুই স্মৃতির পাতায় এসে ভর করছে কিন্তু সবকিছু তো আর লিখে বুঝানো যায় না। বউ হিসেবে যে আদর যতœ পেয়েছি তা অতুলনীয়।
যাইহোক আমাদের শেষ যাত্রা ছিলো আমার ছোট খালা শাশুড়ীর বাড়িতে। উনার ছোটো ছেলের কাছে আমার ননদিনীর বিয়ে দিয়েছি। সেখানও গিয়ে দেখি এলাহি কান্ডকারখানা। খাবারের বিশাল আয়োজন। এখানে বলতে লজ্জা নেই আমি ভীষণ ভোজনরসিক। খেতে আমার ভালোই লাগে। হঠাৎ বাবার একটি কথা মনে হতেই খুব হাসি পাচ্ছে। ছোট বেলা থেকেই আমি এইরকমই ছিলাম।কোথাও থেকে নিমন্ত্রণ আসলে আমি দারুণ খুশি হতাম।

বাবা আমার সেই খুশি দেখে আমাকে বেলপই ঠাকুর বলে ক্ষেপাতেন। বেলপই ঠাকুর নামে এক লোক ছিলেন, কেউ নিমন্ত্রণ দিলে রক্ষা করাই ছিলো তার দায়িত্ব। কোন বাঁধা বিপত্তিই তাকে আটকাতে পারতো না।
যাই-হোক খালা শাশুড়ীর বাড়ি থেকে খাবারের পাট চুকিয়ে আমরা রাত সাড়ে আটটায় সিলেট শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। এইদিনই আমাদের ভ্রমনের সমাপ্তি ঘটালাম। আল্লাহ তায়ালা যদি সুস্থ রাখেন তাহলে আবারও বেরিয়ে পড়ব অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে অন্য আরেকদিন ; সাথে থাকবে আমাদের সন্তানেরা।


অন্যান্য খবর